a silhouette of a young girl holding a red flower against a green background
Premium

ভ্রষ্ট মেয়েবেলাঃ দুই বাংলার দুই কন্যার পাচারের কাহিনি

দেহব্যবসায়ের কাজে লাগানোর জন্য নাবালিকাদের পাচারের ব্যবসায়ে সারা পৃথিবী জুড়ে লেনদেন হয় কয়েকশো কোটি ডলার।এই অবৈধ উদ্যোগের একটি কেন্দ্র হয়ে উঠেছে পশ্চিমবাংলা ও বাংলাদেশ।

কলকাতা লাগোয়া একটি এলাকায় থাকত ‘র’। মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে সে বাড়ি ছেড়েছিল। একটি রেলস্টেশনে কয়েক জন লোকের সঙ্গে তার দেখা হয়। তারা ‘র’-কে ভুল বুঝিয়ে শহরের একটি নিষিদ্ধপল্লিতে নিয়ে যায়। মেয়েটির কথায়, ‘‘ওরা আমার জন্য ফাঁদ পেতেছিল।’’ অনেক মেয়েই কিশোরী অবস্থায় পাচার হয়ে যায়, তাদের বাকি জীবন কাটে বিভিন্ন যৌনপল্লিতে। কিন্তু বিক্রি হয়ে যাওয়ার আগেই ‘র’-কে উদ্ধার করা হয়েছিল। তার কথায়, ‘‘আমার কপাল ভাল ছিল।’’ তার ঠাঁই হয়েছিল ‘সংলাপ’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পরিচালিত ‘স্নেহ’ নামে একটি হোমে। পাচারের শিকার হওয়া, যৌনপল্লি থেকে উদ্ধার হওয়া মেয়েদের জীবন নতুন করে গড়ে তুলতে সাহায্য করে ‘সংলাপ’। এখন সাবালিকা হয়ে যাওয়া ‘র’ এবং এই রচনায় উল্লিখিত আরও কয়েকটি মেয়ের ছবি ‘স্নেহ’তে থাকার সময় তোলা হয়েছিল।

লেখকঃ যুধিজিৎ ভট্টাচার্য
ফোটোগ্রাফারঃ স্মিতা শর্মা

প্রতিবেদন সম্পর্কেঃ পাচার হওয়া মেয়েদের ব্যক্তিজীবন রক্ষার জন্য এবং যৌন অপরাধের শিকার যারা, তাদের চিহ্নিত করার ব্যাপারে ভারত সরকারের যে আইন আছে, তা মেনে আমরা চরিত্রগুলির অথবা তাদের পরিবারের সদস্যদের নাম প্রকাশ করছি না। আমরা এমন ভাবে এদের ফোটো তুলেছি,যাতে মুখ বোঝা না যায়। সেই সঙ্গে চিহ্নিত করা যায়, এমন কিছু জিনিসেরও বদল ঘটানো হয়েছে। কাহিনির চরিত্র যে মেয়েরা, তাদের জন্য আমরা ছদ্মনাম ব্যবহার করেছি।
এই রচনার একটি সংক্ষিপ্ত অনূদিত রূপ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের অক্টোবর ২০২০ সংখ্যায় প্রকাশিত হবে।
রচনাটি ইংরেজি অথবা হিন্দিতে পড়ুন
Read the story in English

একই গণিকালয়ে বিক্রি হয়ে চলে আসার আগে পর্যন্ত সায়েদা আর অঞ্জলি ছিল আর পাঁচজন কিশোরীর মতো। একজন অপর জনের থেকে কয়েকশো মাইল দূরে থাকলেও প্রায় একই পরিবেশে বেড়ে উঠেছিল ওরা। সায়েদা থাকত বাংলাদেশের খুলনা শহরে, অঞ্জলি ভারতের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে।

সব জায়গাতেই এই বয়সের মেয়েদের সাধারণত যে সব আকাঙ্ক্ষা থাকে, এদেরও তা-ই ছিল,বাবা-মায়ের শাসন থেকে বেরিয়ে আসা, ভালোবাসার মানুষকে খুঁজে পাওয়া আর নিজেদের স্বপ্নের মতো বাঁচা। কিন্তু পৃথিবীর কঠোর-কঠিন বাস্তব সম্পর্কে দু‘জনেই ছিল অনভিজ্ঞ, তাই কী নিষ্ঠুরতা তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে, তা ছিল কল্পনার অতীত।

অপরিচ্ছন্ন পাড়ায় দু’কামরার বাড়িতে বেড়ে ওঠা সায়েদা, তার শৈশবের বেশির ভাগ সময়টা একাই কাটিয়েছে। অনেক সকালে তার মা বেরিয়ে যেতেন। তিনি খুলনার অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র নিউ মার্কেটে দোকান সাফাইয়ের কাজ করতেন। সায়েদার বাবা সাইকেল রিকশা চালাতেন। সামান্য পয়সার বিনিময়ে সওয়ারি পৌঁছনো ছিল তাঁর কাজ। পড়াশোনায় তেমন সুবিধা করতে না-পারা সায়েদা ১৩-তে পৌঁছনোর আগেই স্কুল ছেড়ে দেয়। বকুনি দিয়ে মা বলেছিলেন, এর ফলে মুশকিলে পড়বে সে।

মিশুকে, খোলামেলা স্বভাবের, হাসিখুশি সায়েদা যে কোনও কারও সঙ্গে চটপট বন্ধুত্ব পাতাতে পারত। সে সবচেয়ে ভালবাসত নাচতে। বাবা-মা যখন বেরিয়ে যেতেন, তখন টেলিভিশনে হিন্দি আর বাংলা সিনেমার নাচের দৃশ্যগুলি দেখে দেখে নকল করত সায়েদা। মায়ের কাছে ধরা পড়ে গেলে বকুনি খেতে হত। সায়েদার মা আমাকে জানিয়েছিলেন, তাঁর মেয়ে যে সব সময় নাচ-গান করত, প্রতিবেশীরা তা ভাল চোখে দেখতেন না। তাঁর কথায়, “আশপাশের লোকজন ওকে খারাপ বলতো।”

সুন্দরী সায়েদা ছিল পাথরে কোঁদা মসৃণ মুখ আর টানা বড় চোখের একটি মেয়ে। সে সাজতে ভালবাসত। এক সময় সে বিউটি সেলুনে হেয়ারস্টাইল, ত্বক-পরিচর্যা আর প্রসাধনী ব্যবহারের শিক্ষানবিশী শুরু করল। তাঁদের মেয়ে এলাকার ছেলেদের আকর্ষণের কারণ হয়ে উঠছে দেখে উদ্বিগ্ন বাবা-মা ১৩ বছরেই তার বিয়ে দিয়ে দিলেন। বেআইনি হলেও বাল্যবিবাহ দক্ষিণ এশিয়ার বহু জায়গাতেই সাধারণ ঘটনা। কিন্তু বাবা-মা যে ছেলেকে পছন্দ করেছিলেন, সে সায়েদার উপর অত্যাচার করত।এক সময় বাধ্য হয়েই বাপের বাড়ি ফিরে এল সায়েদা।

বাড়িতে ফিরে আসার পর নাচের স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য মায়ের কাছে আবদার করল সায়েদা। সে তার মাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, “আমি নাচের অনুষ্ঠান করে বাড়ির জন্য কিছু রোজগার করতে পারব।” শেষ পর্যন্ত রাজি হন মা, আর সায়েদা তার পর বিয়েবাড়ি-সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাচতে শুরু করল। এই সময়েই সে প্রেমে পড়ে। ছেলেটি তার নাচের স্কুলে মাঝে মাঝেই আসত। একসময় সে সায়েদাকে ভারতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে। স্বপ্ন দেখায়,সেখানে গেলে সায়েদা আরও অনেক বেশি রোজগার করতে পারবে। সায়েদার সামনে এক সম্ভাবনাপূর্ণ ভবিষ্যতের ছবি ভেসে ওঠে। ছেলেটির সঙ্গে পালানো ব্যাপারে সে মনঃস্থির করে ফেলে।

a girl who's face is in shadow
a girl wearing a light-purple top, her hair silhouetted against a patterned wall
প্রথম পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ির অঞ্জলি ১৬ বছর বয়সে একজনকে ভালবেসে ফেলেছিল। প্রেমিকের কাছ থেকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি পেয়ে ঘর ছেড়েছিল সে। প্রতিশ্রুতি রক্ষা তো দূরের কথা, প্রেমিক ও তার এক সঙ্গী মিলে অঞ্জলিকে বিক্রি করে দেয় হলদিয়া শিল্পাঞ্চলের কাছে মহিষাদলের একটি গণিকালয়ে। জোর করে তাকে দিয়ে বেশ্যাবৃত্তি করানো হত। উদ্ধার না করা পর্যন্ত তাকে এখানে প্রতিদিন ২০ জন পর্যন্ত খদ্দেরের যৌনবিনোদন করতে বাধ্য করা হত। উদ্ধার হওয়ার পরে দেড় বছর সে ‘স্নেহ’য় ছিল। অঞ্জলি জানিয়েছে, ওই আশ্রয় শিবিরের অন্য মেয়েরা তার যন্ত্রণা বুঝত। প্রাপ্তবয়স্ক অঞ্জলি এখন বাড়িতে তার মায়ের সঙ্গেই থাকে। মা চান, মেয়ে বিয়ে করে সংসারি হোক। কিন্তু অঞ্জলি আর কাউকে ভালবাসতে চায় না। সে বলে, ‘‘বড় একা লাগে। ‘স্নেহ’-র বন্ধুদের অভাব ভীষণ ভাবে অনুভব করি।’’দ্বিতীয় বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের মেয়ে ‘স’ বাড়ি ছেড়ে ছিল চাকরির লোভে। তার পরিবারের পরিচিত এক জন তাকে ঢাকায় চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই ব্যক্তি ‘স’ –কে তুলে দেন অন্য এক জনের হাতে। তার মাধ্যমে ‘স’ পাচার হয়ে যায় পশ্চিমবঙ্গে। সেখান থেকে তাকে বিক্রি করে দেওয়া হয় মুম্বইয়ের একটি যৌনপল্লিতে। সেখানে দু’বছর থাকার পরে পুলিশ ‘স’-কে উদ্ধার করে। তাকে পাঠানো হয় একটি আশ্রয় শিবিরে। মাস ছয়েক বাদে ‘স’-এর সঙ্গে এক মহিলার দেখা হয়। তিনি ‘স’-কে প্রতিশ্রুতি দেন, বাংলাদেশে পৌঁছে দেবেন। কিন্তু এ বারও প্রতিশ্রুতিভঙ্গ। ওই মহিলা ‘স’-কে বিক্রি করে দেন পশ্চিমবঙ্গের নামখানার একটি গণিকালয়ে। পরবর্তী সময় তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার হওয়ার পরে ‘স’ কিছু দিন ‘স্নেহ’-তে ছিল। এখন সে প্রাপ্তবয়স্কা।

একই কারণে ঘর ছেড়েছিল এক জোড়া উজ্জ্বল চোখের লাবণ্যময়ী মেয়ে অঞ্জলিও। তার পরিবার থাকত বস্তিতে, একটা কোনওমতে তৈরি করা ঘরে। লোকের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করা মায়ের কাছেই সে মানুষ হচ্ছিল। এতই গরিব ছিল তারা যে, স্কুলের জন্য তাদের সাধ্যমতো কেনা জিনিসগুলির অধিকার নিয়ে অঞ্জলির প্রায়ই বোনের সঙ্গে ঝগড়া হত। ভারতে গরিব ঘরের বেশিরভাগ ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে যেমন হয়, ১৩ বছর হওয়ার আগেই স্কুল ছাড়তে হয়েছিল অঞ্জলিকে। এর পরে একটি স্ন্যাক প্যাকেজিং কারখানায় সে কাজ নেয়। স্বল্পবাক অঞ্জলির বেশি বন্ধু ছিল না। তবে বাড়িতে তার প্রাণের বন্ধু ছিল পোষা একটি ছাগলছানা। সবসময় অঞ্জলির পায়ে-পায়ে ঘুরে বেড়াত সে, তার খাবার থেকে খুঁটে খেত, এমনকি, রাতে তার বিছানাতেও শুতো।

এ দিকে কারখানায় আলাপ হওয়া একটি ছেলে অঞ্জলিকে মুগ্ধ করেছিল। সে জানত মা তার বিয়ের জন্য পাত্রের খোঁজ করছেন। কিন্তু অঞ্জলি ঠিক করে, তার ভালবাসার পুরুষের সঙ্গেই জীবন কাটাবে। সেই মতো, ২০১৬ সালের অক্টোবরে দুর্গাপুজোর সময় এক বিকেলে নতুন, উজ্জ্বল রঙের একটি সালোয়ার কামিজ পরে চুপিসারে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় সে। তারপর প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে বাস ধরে সোজা রেলস্টেশন। সেখানে ছেলেটির সঙ্গে অন্য একটি যুবককে দেখে একটু অবাকই হয়েছিল অঞ্জলি। কিন্তু প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে সে তাদের সঙ্গে কলকাতার ট্রেনে উঠে বসল।

সেই বিকেলে হন্যে হয়ে অঞ্জলিকে খোঁজার সময় তার মা জানতে পারলেন যে, কিছুদিন ধরেই তাঁর মেয়ে অন্য কারও সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার ছক করছিল। অঞ্জলি উধাও হয়ে যাওয়ার কয়েকদিন আগে তাদের প্রতিবেশীরা শুনতে পেয়েছিলেন সে তার পোষা ছাগলছানাকে বলছে, “রামু, আমি তো চলে যাব, তোকে তো দেখার কেউ থাকবে না। মা কাজে যায়, দিদিরও বিয়ে হয়ে যাবে। তোকে কে দেখবে?”

ফুলে ফেঁপে ওঠা নারীপাচারের ব্যবসা

যে সব পাপ কাজগুলি মানুষকে বিধ্বস্ত করে, পীড়িত করে— তার মধ্যে অন্যতম দেহব্যবসার কাজ করানোর জন্য ছোট মেয়েদের যৌনদাসী বানিয়ে রাখা। আমার কাছে নিজেদের কাহিনি বলা সায়েদা এবং অঞ্জলি এ রকম অগণিত দুর্ভাগ্যপীড়িত মেয়েদের মধ্যে মাত্র দু’জন। অপরাধ জগতের বেশিরভাগ অবৈধ ব্যবসার মতো এ ক্ষেত্রেও উৎপীড়নের মাত্রা বোঝা কার্যত অসম্ভব। কিন্তু এটা স্পষ্ট, পতিতাবৃত্তিতে নামানোর জন্য পৃথিবী জুড়ে নাবালিকাদের পাচার করার যে ব্যবসা, তার পিছনে লেনদেন হয় কয়েকশো কোটি ডলার। (এই বিষয়টি কেন আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, সেটি এখানে পড়ুন)

ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের করা একটি বহুল ব্যবহৃত সমীক্ষা অনুযায়ী, শুধু ২০১৬ সালেই ১০ লক্ষের বেশি শিশু যৌন ব্যবসার শোষণের শিকার। যে হেতু এই ব্যবসায়ে শিশুদের কাজে লাগানোকে চিহ্নিত করা খুব কঠিন, ওই প্রতিবেদনে মেনে নেওয়া হয়েছে যে, প্রকৃত সংখ্যা হয়তো আরও অনেক বেশি। সারা পৃথিবীতে মানুষ পাচার নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের (ইউনাইটেড নেশনস) ‘অফিস অফ ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইমস'-এর একটি সাম্প্রতিকতম প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিভিন্ন দেশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পাচারের শিকার হওয়া মানুষের সংখ্যা ২০১০ সালে ১৫,০০০ কাছাকাছি বেড়েছিল, ২০১৬ সালে বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ২৫,০০০-এ। তবে এই পরিসংখ্যান প্রকৃত শিকারদের একটি ভগ্নাংশকে নিয়েই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাচারের শিকার হওয়াদের কখনওই চিহ্নিত করা যায় না। এই আপাত স্বল্প-বৃদ্ধি হয়তো আইনের কড়া প্রয়োগের কারণে। কিন্তু গবেষকেরা মনে করেন, এই পরিসংখ্যান আরও ভয়ঙ্কর একটি বাস্তবকে সামনে আনছে— তা হল, যৌনব্যবসায়ে নামানোর জন্য শিশু পাচার-সহ সমস্ত বয়সি মানুষের পাচার বেড়ে চলেছে।

one young woman and one girl standing hand in and looking at a passing train

দক্ষিণ ২৪ পরগনার একটি রেলস্টেশনে তার তুতোভাইয়ের সঙ্গে ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ১৮ বছররে ‘ম’। পশ্চিমবঙ্গের দরিদ্র জেলাগুলির মধ্যে অন্যতম এই দক্ষিণ ২৪ পরগনা। এই জেলা থেকে নারীপাচারের ঘটনাও যথেষ্টই। আলাপ হওয়া একটি লোক ‘ম’-কে দিল্লির একটি যৌনপল্লিতে বিক্রি করে দিয়েছিল। সেখান থেকে সে কোনও মতে বাবাকে ফোন করে গোটা ঘটনা জানায়। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘শক্তি বাহিনী‘র সহায়তায় পুলিশ ‘ম’-কে উদ্ধার করে। সে বলেছে, “ওটা আমার জীবনের একটা অন্ধকারময় অধ্যায়। যখন বাড়ি ফিরেছিলাম, তখন ভীত, লজ্জিত ছিলাম। আজ আমার আর কোনও ভয় নেই।”

জর্জ ম্যাসন ইউনিভার্সিটির পাবলিক পলিসির অধ্যাপক তথা হিউম্যান ট্র্যাফিকিং: আ গ্লোবাল পার্সপেক্টিভ বইয়ের প্রণেতা লুইজ শেলি বলেছেন, “বর্তমানে পৃথিবীতে সাত কোটি শরণার্থী রয়েছেন। আছেন বহু বাস্তুচ্যুত মানুষ এবং আমাদের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েই চলেছে। এর ফলে এটি একটি ফুলে ফেঁপে ওঠা শিল্পে পরিণত হচ্ছে।”

দেহ ব্যবসার জন্য শিশুপাচারের অভিশাপ স্পর্শ করেছে বহু দেশকেই। তবে এই অবৈধ ব্যবসার বড় ঘাঁটি হয়ে উঠেছে পৃথিবীর কয়েকটি জায়গা। তার মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য অঞ্চলটি হল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং তার প্রতিবেশী বাংলাদেশ। এই দু‘টি জায়গা মিলে একসময় বাংলা নামে একটি অভিন্ন প্রদেশ ছিল। প্রায় ১,৪০০ মাইল আন্তর্জাতিক সীমান্তের দু’ধারে থাকা এই দুই অঞ্চলের সংস্কৃতি এবং ভাষা এক। দুটি জায়গাতেই প্রতি বছর কয়েক হাজার নাবালিকাকে যৌনদাসী হিসেবে পাচার করার মতো একই দুর্ভাগ্যের কাহিনি রয়েছে।

পাচার হওয়া এই মেয়েদের সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে কত,তা জানা যায় না। তবে সঠিক না-হলেও যে সব সংখ্যা বলা হয়ে থাকে অথবা অনুমান করা হয়, সেগুলি বিপুল পরিমাণ পাচারের দিকেই ইঙ্গিত করে। ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর হিসেবে, ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে দেশ জুড়ে ৩৪,৯০৮টি নারী পাচারের প্রায় এক-চতুর্থাংশই ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গে। অথচ এই রাজ্যের জনসংখ্যা দেশের জনসংখ্যার প্রায় সাত শতাংশ। এই পরিসংখ্যান তাই অত্যন্ত বিস্ময়কর। শুধু ২০১৭ সালেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে ৮,১৭৮ জন শিশুর নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে, যা ওই বছরে সারা দেশের মোট ঘটনার প্রায় এক-অষ্টমাংশ। নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, পাচার হওয়া এই সব মেয়েদের অনেককেই বিভিন্ন যৌনপল্লিতে বিক্রি করা হয়েছে। বাংলাদেশের চিত্রটা আরও খারাপ। সে দেশের একটি সরকারি হিসেব অনুযায়ী, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ৫০,০০০ মেয়েকে ভারতে অথবা ভারত হয়ে অন্য কোথাও পাচার করা হয়। এই হিসেবের মধ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দেহব্যবসার জন্য বিক্রি হওয়া মেয়েদের ধরা হয়নি।

গণিকাবৃত্তির জন্য নারীপাচারের অন্যতম উৎসস্থল পশ্চিমবঙ্গ। বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘ সীমান্ত এবং লাগোয়া নেপালের সঙ্গে ৬০ মাইলব্যাপী সীমান্তের বহু জায়গাই অরক্ষিত। ফলে পাচারকারীরা সহজেই এই রাজ্য থেকে নারীপাচার করতে পারে। এদের মধ্যে অনেককেই এনে তোলা হয় এক কোটি চল্লিশ লক্ষ জনসংখ্যার কলকাতা মহানগরীর লালবাতি এলাকায়। অন্যদের বিক্রি করে দেওয়া হয় ভারতের বিভিন্ন জায়গায়— দিল্লি, মুম্বই, পুণের যৌনপল্লিগুলিতে(ভারতে বাণিজ্যিক যৌনকর্ম বৈধ, কিন্তু এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত অনেক কাজকর্ম— যেমন দালালি কিংবা গণিকালয় চালানো বেআইনি। শিশুদের দেহব্যবসায়ে নিযুক্ত করাও আইন-বিরুদ্ধ)। এ দেশে পাচার হওয়া মেয়েদের আবার অনেক সময় পশ্চিম এশিয়া অথবা অন্য কোথাও চালান করে দেওয়া হয়। এই খারাপ কাজের ফাঁদে পড়া বেশিরভাগ মেয়েরই নিষ্কৃতি পাওয়ার আর কোনও সুযোগ থাকে না, তাই শেষ পর্যন্ত দেহব্যবসার জীবনকেই মেনে নিতে হয় তাদের।

a police woman at her station at a train station

শিলিগুড়ির নিউ জলপাইগুড়ি রেলস্টেশনে মহিলা পুলিশের নজরদারি। যৌন অত্যাচার এবং পাচার-সহ অন্যান্য অপরাধের কারণে একা পথ চলা মেয়ে এবং মহিলাদের পক্ষে ট্রেন স্টেশনগুলি নিরাপদ না-ও হতে পারে। সাহায্য চাইতে যাতে তারা নিরাপত্তাহীনতায় না-ভোগে, সেই কারণে এ রকম জায়গায় মহিলা পুলিশ মোতায়েন করা হয়।

এই মর্মান্তিক পরিণতির প্রধানতম কারণ এই অঞ্চলের ব্যাপক দারিদ্র। পাচার হওয়া বেশির ভাগ মেয়েই চাকরি কিংবা বিয়ের প্রতিশ্রুতি পেয়ে এই ফাঁদে পা দিয়েছে। দারিদ্রের জাঁতাকলে প্রতিদিন পিষ্ট হওয়ার থেকে বাঁচার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল এরা। যে সমাজে মেয়েদের পুরুষের থেকে কম মূল্য দেওয়া হয় এবং মনে করা হয় তারা সংসারের বোঝা, সেখানে কোনও কোনও মেয়েকে এমনকি, তাদের মা-বাবা অথবা কোনও আত্মীয় যৌন দাসত্বের জন্য বিক্রি করে দেন। “এটি একটি আর্থ-সামাজিক সমস্যা, যা এসেছে দারিদ্র আর অশিক্ষা থেকে,” বলেছেন পুলিশের সুপারিন্টেনডেন্ট তথাগত বসু। সব চেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলির অন্যতম দক্ষিণ ২৪পরগনায় পাচার-বিরোধী তদন্তে নেতৃত্ব দিয়েছেন এই পুলিশ অফিসার।

নারীপাচারের এই উর্বর ভূমিতে ব্যবসার পিছনে থাকা অপরাধ চক্র প্রায় কোনও শাস্তির ভয় ছাড়াই তাদের কাজকর্ম চালিয়ে যায়। কিছু পুলিশ অফিসার এই সমস্যার ব্যাপারে উদাসীন থাকেন অথবা তাঁরা দুর্নীতিগ্রস্ত। নারীপাচার রোখার দায়িত্ব পাওয়া অনেকে আবার অন্যান্য অপরাধের তদন্তের উপর এই বাড়তি বোঝায় জর্জরিত। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে অবশ্য পশ্চিমবঙ্গ-সহ সব রাজ্যে পুলিশের এই দলগুলি যৌনপল্লিতে বিক্রি হয়ে যাওয়া মেয়েদের খুঁজে বার করে উদ্ধার করার কাজ জোরদার করেছে। অনেক ক্ষেত্রেই এই কাজ হয়েছে পাচার-বিরোধী কর্মীদের চাপের ফলে।

দিল্লির স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, শক্তি বাহিনীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ঋষি কান্ত বলেন, “ছোট মেয়েদের নিখোঁজের খবর এলে পুলিশ যাতে তদন্ত শুরু করে, তা আমরা নিশ্চিত করি।” পাচারের শিকার হওয়া কয়েকশো মেয়েকে উদ্ধারে সাহায্য করেছে এই সংস্থা।

কান্তের সাহায্যে শুরু হওয়া সংস্থাটির মতো আরও বেশ কিছু সংস্থাও বাড়তি তৎপরতার সঙ্গে যৌনপল্লিগুলিতে নাবালিকাদের খোঁজ চালাচ্ছে এবং পুলিশের সাহায্য নিয়ে তাদের উদ্ধার করছে। এই সংস্থাগুলির কিছু সদস্য পরিচয় গোপন রেখে গণিকালয় এবং ড্যান্স বারগুলিতে খদ্দের সেজে যায়। সেখান থেকে পাওয়া খবর তারা জানায় পুলিশকে এবং তার পর তাদের সঙ্গে বসে কী ভাবে হানা দিয়ে মেয়েদের উদ্ধার করা হবে, তা ঠিক করে। এটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

সমাজকর্মী তথা মুম্বইয়ের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা দীপেশ ট্যাংক জানিয়েছেন, সঙ্গে নিয়ে যাওয়া স্পাই ক্যামেরা ধরা পড়ে যাওয়ায় একটি গণিকালয়ে তাঁদের একজন তদন্তকারীকে বেধড়ক মারধর করা হয়েছিল তবে এই কাজে সুফলও মেলে। মুম্বইয়ের একটি ড্যান্স বারে হানা দেওয়ার ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, “একটা রেড (তল্লাশি) যে হতে যাচ্ছে, লোকগুলি তার কোনও আঁচই পায়নি। ওরা নিয়মিত পুলিশকে টাকা দিত। আমরা ঢুকতে একবারে হাঁ হয়ে গিয়েছিল। ওই তল্লাশি অভিযানে ওদের বিরাট ক্ষতি হয়েছিল। ওরা নানা ভাবে শাসানি দিয়ে রুখতে চেয়েছিল আমাদের।” সেই অভিযানে সেখানে আটকে থাকা ১২ জনেরও বেশি মেয়েকে উদ্ধার করা গিয়েছিল।

এ সব সত্ত্বেও যৌন ব্যবসার জন্য মেয়ে পাচার রুখতে ভারতের প্রচেষ্টাকে হাতুড়ি দিয়ে দুর্গ ভাঙার সঙ্গে তুলনা করা যায়। যে বিপুল হারে পাচারের ঘটনা এখানে ঘটে, তা বন্ধ করার জন্য আরও কঠোর আইনের প্রয়োজন। প্রয়োজন তা ধারাবাহিক ভাবে প্রয়োগের। সেটা করতে হবে শুধু নারীপাচা্রের ঘটনাগুলির তদন্তের জন্য নিযুক্ত কোনও জাতীয় সংস্থার মাধ্যমে।

যৌনপল্লি থেকে উদ্ধার হওয়া অনেক মেয়েকেই নিজের ভরণপোষণের ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হয়। এ ব্যাপারে তাদের দরিদ্র এবং সামাজিক লজ্জায় লজ্জিত পরিবারের প্রায় কোনও সাহায্যই তারা পায় না। এই সব মেয়েরা যাতে তাদের পরিবারের সঙ্গে আবার মিশে যেতে পারে, সামাজিক কলঙ্ক অতিক্রম করে সুন্দর ভাবে নিজেদের জীবন গড়ে তুলতে পারে সেই উদ্দেশ্য নিয়ে বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পাচারের শিকার হওয়া মেয়েদের পুনর্বাসনের প্রকল্প পরিচালনা করে। কিন্তু সত্যিকারের কোনও পরিবর্তন আনতে গেলে রাজ্য সরকারগুলির দিক থেকে এদের সাহায্যের জন্য অনেক কিছু করা দরকার। কান্তের কথায়, “তারা যেন আমার আপনার মত বাঁচতে পারে, সে জন্য এদের ক্ষমতায়নের প্রয়োজন।”

police officer standing on boat.

সুন্দরবন অঞ্চলে হুগলি নদীতে জলযানে করে টলহরত পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের দক্ষিণাংশ জুড়ে থাকা এই গভীর ম্যানগ্রোভ অরণ্যের ভিতর দিয়ে গিয়েছে এই জলপথ। ধরা পড়ার ভয়ে নারীপাচারকারীরা প্রায়শই এই নদীপথ ব্যবহার করে।

‘মেরে নদীতে ভাসিয়ে দেব’

ছেলেটির সঙ্গে যে দিন সায়েদা বাড়ি থেকে পালিয়েছিল, সে দিন খুলনা থেকে বাসে করে ভারতের সীমান্তের কাছে একটি শহরে নিয়ে আসা হয় তাকে। রাতে সেখানে পৌঁছনোর পর একটি জঙ্গলের মধ্য দিয়ে তারা হেঁটে আসে একটি নদীর ধারে। একই রাস্তা দিয়ে আরও অনেককে আসতে দেখেছিল সায়েদা। তাদের মধ্যে ছিল তার মতো অল্পবয়সি মেয়েরাও, তবে তা নিয়ে তেমন কিছু ভাবেনি সে। নদীর ধারে এসে তার পুরুষ-বন্ধু এক পুলিশকর্মীকে ঘুষ দিলে দু‘জনে মিলে ওঠে একটি নৌকোয়। সেই নৌকো তাদের পৌঁছে দিয়েছিল নদীর অন্য তীরে, ভারতে।

ছেলেটি এরপর সায়েদাকে নদীর কাছাকাছি একটি বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে তারা কয়েকটা দিন কাটিয়েছিল। বাংলাদেশ থেকে আনা আরও একটি মেয়ের সঙ্গে সেখানে পরিচয় হয় সায়েদার। তখন তার একটু সন্দেহ হয়। তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে— পুরুষ-বন্ধুটির কাছে জানতে চেয়েছিল সায়েদা। কোনও রাখঢাক না-করেই সেই পুরুষ-বন্ধু সায়েদাকে জানিয়েছিল, গণিকালয়ে কাজ করতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে। শোনা মাত্রই আপত্তি জানিয়েছিল সায়েদা। তার কথায়, “ও আমাকে শাসিয়েছিল— খুন করে নদীতে ভাসিয়ে দেব।”

সেখান থেকে সায়েদা পালিয়ে যেতে পারত, কিন্তু জানত না কার কাছে গিয়ে সাহায্য চাইবে সে। বেআইনি ভাবে ভারতে ঢুকেছে, তাই কী ভাবে সে পুলিশের কাছে যাবে, ভেবে পায়নি। তার কথায়, “আমি এত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যে রাজি হয়ে যাই। বলি, ঠিক আছে। আমি সেখানে নাচব, কিন্তু অন্য কোনও কাজ করবো না।”

ছেলেটি এর পর সায়েদাকে বিক্রি করে দেয় মহিষাদলের একটি গণিকালয়ে। জায়গাটি কলকাতা থেকে ৪০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে নদী-বন্দর তথা শিল্পশহর হলদিয়ার একটি মফস্‌সল। সায়েদা এবং অঞ্জলিকে নিয়ে ওই গণিকালয়ে আটকে থাকা প্রায় ১২টি মেয়ে আমার সঙ্গে কথা বলে জানিয়েছিল, সেখানে কী রকম জীবন কাটাতে হয়েছিল তাদের।

এখানে দেওয়া বিবরণগুলি এইসব মেয়েদের সাক্ষাৎকার থেকেই নেওয়া। তাদের বন্দিজীবন নিয়ে বলা সব ক‘টি মেয়ের কাহিনি এক।

একটি জাতীয় সড়কের পাশে পর পর অবস্থিত এই ধরণের কতকগুলি গণিকালয়ের একটিতে ঠাঁই হয়েছিল সায়েদা এবং অঞ্জলির। ’সংকল্প‘ নামে একটি হোটেল, যা আদতে একটি দোতলা বাড়ি, তার ভিতরে চলত এই ব্যবসা। সেখানে ছিল ছোট ছোট ২৪টি ঘর আর রেস্তরাঁর পিছনে ছিল একটি ড্যান্স বার। মেয়েরা জানিয়েছিল, এই ব্যবসা চালাত প্রশান্ত ভক্ত নামে একটি লোক। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তার আইনজীবীও কথা বলতে অস্বীকার করেন।

a girl holding a red tulip, with her face silhouetted against a blue background
a girl who's orange sari is silhouetted against a textured background
প্রথম ‘অ’, এখন বয়স ১৯। বছর কয়েক আগে একটি লোকের সঙ্গে সে পালিয়ে গিয়েছিল। লোকটি তাকে বিক্রি করে দেওয়ার মতলব করছে শুনে ফেলার পরে ‘অ’ পালিয়ে যায়। দুর্দশায় পড়া শিশুদের সাহায্যকারী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘চাইল্ডলাইন’-এর প্রতিনিধিরা ক্যানিং রেলস্টেশনে দেখতে পান তাকে। পরে ‘স্নেহ’তে নিয়ে আসা হয় ‘অ’-কে।দ্বিতীয় পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন আঞ্চলের একটি গ্রামের মেয়ে ‘ন’। তার যখন ১৬ বছর বয়স, তখন তার বিয়ে দেওয়া হয়। তার স্বামী অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে থাকবেন বলে, ‘ন’-কে ছেড়ে চলে যান। এর পরই এক পরিচিত ব্যক্তি ‘ন’-কে একটি গণিকালয়ে পাচার করে দেয়। লোকটি তাকে সহানুভূতি দেখানোর ভান করেছিল। শেষ পর্যন্ত ‘ন’-কে উদ্ধার করে ‘স্নেহ’তে রাখা হয়। এখন সে প্রাপ্তবয়স্কা।

সায়েদার বয়স তখন মাত্র ১৪। সে মনে করত শুধু খদ্দেরদের জন্য নেচেই পার পেয়ে যাবে।সায়েদা জানিয়েছে, খুব তাড়াতাড়ি ভক্ত তার সেই ধারণা চুরমার করে দিয়েছিল। সে তাকে ধর্ষণ করেছিল। পরে সায়েদা অন্য মেয়েদের কাছ থেকে শুনেছে, কোন মেয়ের জন্য খদ্দেরদের থেকে কত টাকা চাওয়া হবে, এ ভাবেই ভক্ত বুঝে নিত। যে জনা ২০ মেয়ে (তাদের বেশির ভাগই নাবালিকা) তার নিয়ন্ত্রণে থাকত, তাদের বিভিন্ন দর ঠিক করে নানা সাংকেতিক রঙে বিজ্ঞাপনের ব্যবস্থা করেছিল ভক্ত। ড্যান্স বারের ভিতরে মেয়েদের বসিয়ে রাখা হত প্লাস্টিকের চেয়ারে, আর খদ্দেররা দেখে শুনে যাকে পছন্দ করত, তাকে নিয়ে যেত।

সায়েদার মতো নতুন আসা মেয়েরা, যাদের কুমারী বলে ধরে নেওয়া হত, তাদের দাম ছিল সবচেয়ে বেশি— ৫০০ টাকা। তাদের বসানো হত সাদা চেয়ারে। অন্যরা বসত নীল (৪০০ টাকা) এবং সবুজ (৩০০ টাকা) চেয়ারে। যে সব মেয়েদের ওজন বেশি অথবা যারা কম আকর্ষণীয়া বলে ভক্ত মনে করত, তাদের বসানো হত লাল রঙের চেয়ারে। তাদের দর ছিল ২৫০ টাকা। টাকাটা খদ্দেররা দিত ভক্তকে। মেয়েদের সে বলেছিল, তাদের জন্য খরচ-খরচার হিসেব হয়ে গেলে পাওনা টাকা দিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু মেয়েরা জানিয়েছে, কোনও দিনই কোনও টাকার মুখ তারা দেখেনি।

মেয়েরা বলেছে, যাতে তারা সহজেই বশ মানে, সেই উদ্দেশ্যে ভক্ত তাদের মদ খেতে বাধ্য করত। প্রথমে সায়েদা এ ব্যাপারে বাধা দিলেও পরে সে দেখল নেশার ঘোরে থাকলে যৌনদাসত্বের যন্ত্রণাবোধটা অনেকটা ভোঁতা হয়ে যায়। তাই বেশি করে মদ খেতে শুরু করে সে। তার কাছে আসা খদ্দেরদের তার জন্য মদ আনতে বলতো সে। সায়েদা বলেছে, “এ ভাবেই আমি সময়টা কাটাতাম— বসে বসে মদ খেয়ে।”

সায়েদা দু’বছর থাকার পর অঞ্জলিও ১৬ বছর বয়সে বিক্রি হয়ে এসে ওঠে ‘সংকল্প’-এ। অঞ্জলি যে লোকটিকে বিয়ে করবে বলে স্বপ্ন দেখেছিল, সে এবং আর একটি যুবক তাকে প্রথমে কলকাতা, তার পরে মহিষাদলে নিয়ে যায়। ওরা অঞ্জলিকে এক বোতল বিয়ার দিয়েছিল। সেটা খেয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ে। জেগে উঠে দেখে তার পুরুষ-বন্ধুর সঙ্গী তার জন্য সাবান, শ্যাম্পু, চিরুনি আর প্রসাধনের কিছু জিনিস নিয়ে এসেছে। সে অঞ্জলিকে বলে সেই বিকেলে একজনের সঙ্গে দেখা করতে নিয়ে যাওয়া হবে তাকে।

অঞ্জলি কোনও প্রশ্ন করেনি। স্বেচ্ছায় সে ওই যুবকদের সঙ্গে যায় এবং এই গণিকালয়ে এসে ওঠে। কিন্তু সেখানে ঢুকতেই আধোআলোর ঘর দেখে ভয় ভয় করতে শুরু করে তার। অঞ্জলি জানতে চায়, “এটা কোন জায়গা?” ছেলে দুটি তাকে বলে, এটা একটা হোটেল, এখানেই তাকে কাজ করতে হবে। আতঙ্ক গ্রাস করতে থাকা অঞ্জলির প্রশ্ন, “কাজ?কী কাজ?” কী কাজ, সেটা তাকে বুঝিয়ে দেওয়ার পর তার চোখ জলে ভরে যায়। বিষয়টি মেনে নেওয়ার জন্য অঞ্জলির পুরুষসঙ্গীর বন্ধু অনুনয় করেছিল তার কাছে। বলেছিল, অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য তার টাকার বড় দরকার। সে অঞ্জলিকে কথা দিয়েছিল, তাকে ফিরিয়ে নিতে দু’মাস বাদে আবার আসবে। কিন্তু তারা আর কোনও দিন আসেনি।

প্রথম দিনেই অঞ্জলির কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, কোনও প্রতিরোধই এখানে কাজ আসবে না। মেয়েরা আমাকে জানিয়েছিল তারা ভক্তকে ভীষণ ভয় পায়। তারা জানিয়েছিল, কোনও বিষয়ে অনুযোগ করলে কিংবা কথার অবাধ্য হলে ভক্ত তাদের পাশবিক ভাবে মারধর করত, এমনকি জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়ে শরীরে দগদগে পোড়া দাগ করে দিত সে।

a girl holding light pink tulips with her face silhouetted against a patterned wall
a woman in a hot pink sari
প্রথম ‘স’-এর পরিবার এতই গরিব ছিল যে, খাবার কেনার মতো টাকাও সবসময় তাদের থাকত না। সেই সুযোগ নিয়ে তাকে দেখাশোনার আশ্বাস দিয়েছিল ঢাকার একটি লোক। তার সঙ্গেই পালিয়েছিল ‘স’। এখন সে সাবালিকা। তার কথায়, “কী করে জানব যে, আমাকে বিক্রি করে দেওয়ার মতলব আছে তার?...আমার জীবনে প্রচুর যন্ত্রণা।” নদীপথে তাকে পাচার করে দেওয়া হয়েছিল ভারতে। তার পর তাকে একটি গণিকালয়ে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। এক মহিলাকে বিশ্বাস করে সেখান থেকে সে পালিয়েছিল, কিন্তু ওই মহিলা তাকে অন্য একটি গণিকালয়ে বিক্রি করে দেয়। ‘স’-কে উদ্ধার করে ‘স্নেহ’তে নিয়ে আসা হয়েছিল।দ্বিতীয় ‘ম’ এখন ১৯। ১৬ বছর বয়সে সে তার দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাড়ি ছেড়েছিল। ফোনে প্রেম নিবেদন করা একটি লোক তাকে ফুসলিয়েছিল। লোকটির সঙ্গে দেখা হলে সে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। একদিন সে তাকে ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে দিল্লি নিয়ে যায় এবং বিক্রি করে দেয় একটি যৌনপল্লিতে। সেখানে ‘ম’-কে মারা হত, না-খাইয়ে রাখা হত এবং বাধ্য করা হত দিনে ৩০ জন পর্যন্ত খদ্দেরের সঙ্গে শুতে। দু-বার পুলিশি অভিযানের সময় গণিকালয়ের মালিক তাকে লুকিয়ে রেখেছিল। তৃতীয়বার পুলিশ তাকে উদ্ধার করে।

মেয়েদের কাছে এই গণিকালয় ছিল একটা জেলখানার মতো। চারপাশ ঘেরা এই বাড়িটির গেট এবং সদর দরজা সবসময় বন্ধ করা থাকত অথবা কেউ সেখানে পাহারা দিত। বয়স্ক একজনের পাহারায় সামনের একটা দোকানে গিয়ে খাওয়ার জন্য কেবলমাত্র মাঝরাতে বেরোতে দেওয়া হত তাদের। মেয়েদের এক একটি নাম তৈরি করে লোকটি রঙ্গ তামাশা করত তাদের সঙ্গে। নিষ্ঠুর বাস্তবে এতেই যেন সহানুভূতির ছোঁয়া পেত তারা।

দিনে-রাতে, সবসময়ই খদ্দেররা আসত আর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২০ বার পর্যন্ত ধর্ষিত হত মেয়েরা। এমনকি ভোর ৪টার সময়, যখন শরীর একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য আকুল, তখনও কোনও মত্ত পুরুষ তাদের শোওয়ার জায়গায় ঢুকে পড়েছে পছন্দের মেয়ে বাছতে। শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করতে মেয়েরা ব্যথা কমানোর ওষুধ খেত, কিন্তু মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি কোথায়? সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস শরীরের উপর এই অত্যাচার সহ্য করতে করতে একসময় যেন তারা প্রায় অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছিল। যখন বয়স্ক খদ্দেররা আসত, অঞ্জলির কথায়, “এত লজ্জা করত আমার বুড়ো লোকেদের সঙ্গে যেতে…বাপের-বয়সি, আরও বড়।...”

পাচার হওয়ার তীব্র মানসিক আঘাত আর পশুর মত বেঁচে থাকা- প্রতিদিনের এই ভয়াবহতা মেয়েদের একে অন্যের উপর নির্ভরশীল হতে শিখিয়েছিল।শান্ত, অন্তর্মুখী অঞ্জলি এ ব্যাপারে সায়ে্দার থেকে আলাদা ছিল না। সায়েদা আবার মদ খেয়ে থাকলে এতটাই মাথা গরম করত যে, কোনও কোনও সময়ে সে খদ্দেরকে লাথি মেরে বসত। ব্যক্তিত্বে বৈপরীত্য থাকলেও অথবা হয়তো সেই কারণেই—এই দু’জনে বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। যে প্রেমিকের সঙ্গে ঘর ছেড়ে পালিয়ে এসেছিল, তার প্রবঞ্চনার যন্ত্রণাই শুধু নয়, আরও কিছু ব্যাপারে একই অনুভূতি ছিল দু’জনের মধ্যে, যা তারা ভাগ করে নিয়েছিল। এই দু’জনের মা-ই লোকের বাড়ি কাজ করে তাদের বড় করেছেন। এ ছাড়া নিজে না করলেও সায়েদার মতো নাচগানের ব্যাপারে প্রবল উৎসাহ ছিল অঞ্জলিরও। সায়েদার মতো সে-ও ভালবাসত মেক-আপ করতে।

গণিকালয়ে কয়েক বছর কাটিয়ে ফেলা কিছু মেয়ের কাছে খদ্দেরদের দেওয়া সেলফোন ছিল। কখনও কখনও তারা তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলত। কোনও কারখানা অথবা কোনও বাড়িতে কাজ করছে এবং তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে, এই সব মিথ্যা বলত পরিবারের লোকজনদের। সায়েদাও একদিন খুলনায় তার মাকে ফোন করে জানায়, সে ভারতে নৃত্যশিল্পী হিসেব কাজ করছে আর এখন তার পক্ষে বাড়ি ফেরা সম্ভব না। প্রচণ্ড লজ্জায় সত্যি কথাটা বলেনি সায়েদা। তার মনে হয়েছিল, এ সব জানলে মা-বাবা একেবারে ভেঙে পড়বেন। পুলিশকে কিছু জানাতেও প্রবল ভয় ছিল তার। সে বিশ্বাস করত এতে ভাল কিছু হবে না। মেয়েরা বেশ কয়েকজন পুলিশ অফিসারকে জানত, যাঁরা ওই গণিকালয়ে খদ্দের হিসেবে আসতেন। এঁরা ছিলেন ভক্তের বন্ধুস্থানীয়।

কখনও-সখনও পুলিশ হানা দিত। মেয়েরা বলেছে, ভক্ত আর তার কর্মচারীরা সবসময় আগেভাগেই খবর পেয়ে যেত। তারা মেয়েদের এক জায়গায় জড়ো করে পিছনের দরজা দিয়ে পাঠিয়ে দিত মাঠ পেরিয়ে একটা নিরাপদ আস্তানায়। কিন্তু সেখানেও যৌনকর্ম থেকে নিস্তার ছিল না তাদের। সেই অস্থায়ী লুকিয়ে থাকার জায়গাতেও খদ্দের নিয়ে আসত ভক্ত। অনেক সময়ই মাটিতে বিছানার চাদর বিছিয়ে তার উপরেই খদ্দেরদের সঙ্গে শুতে বাধ্য করা হত মেয়েদের।

যদিও ২০১৭ সালের এপ্রিলের এক বিকেলে পুলিশের একটা দল হানা দিল সেই গণিকালয়ে এবং তার পাশের একটিতে। এ বার ভক্তর কাছে কোনও আগাম খবর ছিল না। অঞ্জলি, সায়েদা এবং আরও কয়েকটি মেয়ে জানিয়েছে, পুলিশের থেকে পালাতে তারা পিছনের দরজা দিয়ে দৌড় দিয়েছিল। ভক্তর কাছে তারা শুনেছিল পুলিশ ধরতে পারলে তাদের আটকে রাখবে আর এই গণিকাবৃত্তির কথা জেনে যাবে তাদের পরিবার। শিশুদের পাচার এবং তাদের যৌন শোষণ নিরোধী আইন অনুযায়ী, ভক্তকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ, সেই সঙ্গে আরও ১২ জনকে। অঞ্জলি, সায়েদার সঙ্গে আরও ১৮ জন মেয়ে ও মহিলাকে উদ্ধার করা হয়েছিল।

ওরা মুক্তি পেল বটে, কিন্তু এ মুক্তি বাড়ি ফেরার জন্য নয়।

school girls walking down lane.

দক্ষিণ ২৪ পরগনার একটি অঞ্চলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছে মেয়েরা। ভারতের গ্রামীণ অঞ্চলে বহু মেয়ের পড়াশোনা অর্থের অভাবে হাইস্কুল যাওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়। গরিব পরিবারগুলি সাধারণত বাড়ির ছেলেদের শিক্ষা এবং মেয়েদের বিয়ের জন্য অর্থ খরচ করে। বাল্যবিবাহ বেআইনি হলেও এই প্রথার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে বহু জায়গায়। নাবালিকাদের পাচারের হার এই অঞ্চলে অত্যন্ত বেশি। অনেক ক্ষেত্রে স্কুলে পৌছঁতে মেয়েদের দীর্ঘ পথ পেরোতে হয়, ফলে তাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে পরিবার।

যে ভাবে ফাঁদে ফেলা হয় অরক্ষিত নাবালিকাদের

দক্ষিণ ২৪ পরগনায় হুগলি নদীর তীরে ছোট শহর ডায়মন্ড হারবারে এক শরতের বিকেলে সব্জি আর মাছ বিক্রেতারা একটি সংকীর্ণ দু-লেনের হাইওয়ের ধারে বসে তাঁদের জিনিস বিক্রিতে ব্যস্ত। হর্ন বাজিয়ে আর ধোঁয়া ছেড়ে ট্রাক যাচ্ছে সামনের রাস্তা দিয়ে। সামান্য পসরা সাজিয়ে বসা বেশিরভাগ বিক্রেতাই কোনওমতে দিন চালানো কৃষক অথবা ছোট মাপের মৎস্যজীবী। পলিথিন চাদরের উপর এক ঝুড়ি ঢ্যাঁড়শ, কয়েকটা বেগুন, এক বস্তা আলু বিছিয়ে উবু হয়ে বসেছেন এক বয়স্কা। এক হাত দূরেই পায়ের উপর পা দিয়ে বসে একটি লোক বালতি দুয়েক কুচো চিংড়ি নিয়ে। তাঁর মত এদিক-সেদিক আরও কয়েকজন তাঁদের ধরা চিংড়ি বিক্রি করছেন।

এই এলাকার মানুষেরা, যাদের অনেকেই চরম দারিদ্র নিয়ে বেঁচে থাকেন, তাঁদের তুলনায় এই সামান্য ব্যবসায়ীরাই হয়তো একটু ভাগ্যবান। ভারতের অন্যতম বড় জেলা, দক্ষিণ ২৪ পরগনার একটা বড় অংশই অনুন্নত। শিল্প অতি সামান্য সেখানে, চতুর্দিকে এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা। এই জেলার দক্ষিণ দিকটি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের দু‘দিক জোড়া বিশাল ব-দ্বীপের একটি অংশ। এই ব-দ্বীপ হয়ে হুগলি, গঙ্গা এবং অন্য অনেক নদী বঙ্গোপসাগরে মিশেছে।

এই অঞ্চলে জীবিকা হিসেবে কৃষিকাজ লাভজনক নয়। কারণ, বর্ষাকালে চাষের জমি প্রায়ই জলে ডুবে যায়। প্রায় ৪,০০০ বর্গমাইল বিস্তৃত বিভিন্ন দ্বীপ, জলাভূমি এবং ম্যানগ্রোভ জঙ্গল নিয়ে যে সুন্দরবন এলাকা, সেখানে চরম দারিদ্র। পরিবর্তিত জলবায়ুর কারণে প্রায়শই আছড়ে পড়া সাইক্লোন এখানে কৃষিকাজ এবং মাছ ধরার কাজকে আরও কঠিন করে তুলেছে।

এই অর্থনৈতিক দুরবস্থার ফলে দক্ষিণ ২৪ পরগনার গ্রামগুলির বেশির ভাগ নারী-পুরুষ জীবিকার জন্য বাড়ি ছেড়ে দূরবর্তী অঞ্চলে যেতে বাধ্য হন। প্রত্যেক দিন সকালে ডায়মন্ড হারবার, ক্যানিং-এর মতো শহরগুলি থেকে এঁরা ভিড় ট্রেনে চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে কলকাতা এবং তার লাগোয়া এলাকাগুলিতে কারখানা অথবা নির্মাণ কাজে যোগ দিতে যান। অনেকেই মধ্যবিত্ত বাড়িগুলিতে রান্না অথবা ধোয়া মোছার কাজ করেন।

“এঁরা রাতে বাড়ি ফেরেন। এই মাঝের সময়টায় তাঁদের সন্তানদের দেখাশোনার কেউ নেই। তখনই পাচারের সুযোগটা তৈরি হয়,” বলেছেন নীহার রঞ্জন রপ্তান, গোরানবোস গ্রাম বিকাশ কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর। ক্যানিংয়ের এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটি পাচারের শিকার হওয়া মেয়েদের উদ্ধার করা এবং পুনর্বাসন দেওয়ার কাজে সাহায্য করেছে। একটি পাচার হওয়া মেয়েকে খোঁজার জন্য রপ্তান ১৯৯৫ সালে প্রথমবার পুলিশের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। তিনি জানিয়েছেন, তার পর থেকে অল্পবয়সি মেয়েদের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া যেন রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, “এক সময় এখানে প্রচুর ডাকাতির ঘটনা ঘটত। এখন অনেক কমে গিয়েছে।” তিনি জানিয়েছেন, এই এলাকায় নারীপাচার এখন অনেক বেশি লাভজনক।

a group of people walk past a person blowing up a balloon at an outdoor festival

পশ্চিমবঙ্গের সর্বাধিক জনপ্রিয় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা উদ্‌যাপনে কলকাতার ভিড়। ন’দিনের এই উৎসবে শহরে মানুষের ঢল নামে। উৎসবের আনন্দের কোনও বাঁধন থাকে না। পুজোর দিনগুলিতে ছেলে-মেয়েরা পরস্পরের সঙ্গে আরও খোলাখুলি মেলামেশার সুযোগ পায়। জানা যায়, শিকার চিহ্নিত করে তাদের ফাঁদে ফেলার উদ্দেশ্যে এই ভিড় এবং খোলামেলা পরিবেশকে কাজে লাগায় পাচারকারীরা।

পাচারকারী দলগুলি এইসব মেয়েদের চরম পারিবারিক দারিদ্র এবং অসহায়তার সুযোগ নিয়ে থাকে। কলকাতার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ’সংলাপ‘-এর তপতী ভৌমিক বলেন, “আমি যদি পাচারকারী হই…তা হলে আমাকে আগে দেখতে হবে মেয়েটি ক্ষুধার্ত পরিবারের কি না এবং মরিয়া হয়ে কোনও কাজ খুঁজছে কি না অথবা প্রেম-ভালবাসার দিকে ঝোঁক আছে কি না।” পাচারকারীদের কবলে পড়া মেয়েদের সাহায্য করে থাকে এই সংস্থাটি। আয়ত চোখ এবং গভীর মানবতাবোধের অধিকারিণী এই মহিলার কথায় প্রকাশ পায় অসীম করুণা।

তপতী জানিয়েছেন, পাচারকারী দলগুলির হয়ে কাজ করা কিশোর-যুবকেরা গ্রাম ও ছোট শহরগুলিতে মেয়েদের খোঁজে ঘোরাফেরা করে। বয়ঃসন্ধির মেয়েদের নানা ভাবে প্রলুব্ধ করে এরা প্রেমের জালে জড়িয়ে ফেলে। তপতীর কথায়, “এই সব কিশোর-যুবকেরা প্রেমে পড়া মেয়েদের কালীঘাটে নিয়ে গিয়ে লোক দেখানো একটা বিয়ে করে এবং কোথায় একটা বাড়ি ভাড়া করে কিছু দিন কোথাও। যেন নবদম্পতিরা রয়েছেন।”

যে সব খরচ ওই কিশোর-যুবকেরা এই সময় করে, তা মেয়েটিকে বিক্রি করে পাওয়া টাকার তুলনায় নগণ্য। তপতী বলেছেন, “ওই মেয়েটিকে নেওয়ার জন্য হয়তো বসে আছে সোনাগাছি, কামাতিপুরা, জি বি রোডের গণিকালয়গুলির শেঠানিরা(মালকিন)।” এই জায়গাগুলি যথাক্রমে কলকাতা, মুম্বই এবং দিল্লির লালবাতি অঞ্চল। তপতী জানিয়েছেন, ছেলেটি যদি মেয়েটির জন্য ২০,০০০ টাকাও খরচ করে, তাকে বিক্রি করা হবে ৭০,০০০ টাকায় (প্রায় ৬৫০ ডলার)।তাহলে নীট লাভ ৫০,০০০ টাকা।” রীতিমতো ভাল লাভ এটা—একজন কারখানা শ্রমিকের পাঁচ মাসের মজুরির সমান।

দারিদ্রের মধ্যে বেড়ে ওঠা মেয়েদের কাছে সেলফোন অথবা প্রসাধনী সামগ্রীর মতো অতি সাধারণ শৌখিন জিনিসগুলিও অতি আকর্ষণীয় মনে হয়। “টেলিভিশনের সোপ অপেরায় যেমন দেখা যায়, তেমন একটা জীবনই আকাঙ্ক্ষা করে এরা,” তপতী বলেন।

a woman sitting on a step outside of a building on the phone

শিউলি, ২৭ বছর বয়সি যৌনকর্মী। খদ্দেরের অপেক্ষায় কলকাতার কালীঘাটের নিষিদ্ধপল্লিতে। তাঁর কথায়, “গরিব ঘরে জন্মানো মেয়েদের সারা জীবনই নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।’’ ১৩ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া শিউলি একসময় তাঁর ছেলের হাত ধরে স্বামীকে ছেড়ে এসেছিলেন। কিন্তু বাবা-মা বাড়ি ফিরতে দেননি তাঁকে। এক সময় অল্পের জন্য পাচার হওয়া থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি। লোকের বাড়িতে কাজ করে প্রয়োজনীয় আয় না-হওয়ায় দেহব্যবসার পথে পা রাখা। খদ্দেরদের ঔরসে জন্ম নেওয়া আরও দু’টি ছেলের জননী তিনি।

যৌনপল্লিতে বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর পাচার হওয়া বেশিরভাগ মেয়েরই মন এত ভেঙে যায় যে, প্রতিরোধের কথা এদের দূরতম চিন্তাতেও আসে না। এরা সাধারণত পাচারকারী লোকজনদের হাতেই হিংসা অথবা ধর্ষণের শিকার হয়। বাড়ি থেকে ফুসলিয়ে অথবা বলপ্রয়োগ করে নিয়ে আসার ফলে নতুন বিক্রি হওয়া মেয়েদের মানসিক আঘাত এতটাই তীব্র থাকে যে অন্য অল্পবয়সি মেয়েদের সান্নিধ্যে গণিকালয়ের পরিবেশও যেন প্রথম প্রথম স্বস্তিদায়ক বলে মনে হয় তাদের।

“অন্তত অপহরণ করা লোকগুলির খপ্পরের বাইরে তো আসা গেছে”—এ রকমই মনে হয় মেয়েদের, বলেছেন কলকাতার লালবাতি এলাকা কালীঘাটে যৌনকর্মীদের ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘নিউ লাইট’-এর প্রতিষ্ঠাতা ঊর্মি বসু।

তিনি জানিয়েছেন, মেয়েরা গণিকালয়ে আসার পরের দিনগুলিতে সেখানে তাদের সঙ্গীরা সাবধান করে দেয়, “পালানোর চেষ্টা কোর না, করলে খুন হয়ে যাবে।” সেই কারণে একটা ভয় কাজ করতে থাকে তাদের মধ্যে, আর সমস্ত আশাও হারিয়ে যায়।…একটি মেয়েকে পেতে যে খরচ করা হয়েছে, গণিকালয়ের মালিক অথবা মালকিন চায় তা খুব তাড়াতাড়ি তুলতে।তারা জানে সময়ের সঙ্গে মেয়েটির রোজগারের ক্ষমতা কমে যাবে।

“এই কারণেই অল্পবয়সি মেয়েগুলোকে খদ্দেরদের সঙ্গে দিনে ২০ থেকে ৩০ বার শুতে বাধ্য করা হয়,” প্রায় বুঁজে আসা গলায় ঊর্মি বললেন। তিনি বলতে থাকেন, “ছ’মাস গণিকালয়ে কাটানোর পরেই একটি মেয়ের আগেকার এবং বর্তমানের ব্যক্তিত্বের মধ্যে এক বিপুল পার্থক্য গড়ে ওঠে। তাই সেখানে বছর দুয়েক থাকার পরে তারা ঠিক করে ফেলে, ‘ঠিকই তো আছে, অন্য কী পথ আর খোলা আছে আমার জন্য?’”

a woman standing in a doorway
a woman posing for a portrait looking through a window
প্রথম কাজল দলপতির বিয়ে হয়েছিল ১৫ বছর বয়সে। ভ্রুণ নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর স্বামীকে ছাড়তে হয়েছিল। তিনি জানিয়েছেন,স্বামীকে ছেড়ে বাড়ি ফিরলেও বাবা এবং সৎমা তাঁকে সাহায্য করতে চাননি। কলকাতায় থাকা এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় কাজ পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁকে বিক্রি করে দিয়েছিল একটি গণিকালয়ে। এখন কাজল ২৬। কাজল কলকাতার কালীঘাটের যৌনপল্লিতে রয়েছেন গত ছ’বছর ধরে।দ্বিতীয় পরিবারকে আর্থিক ভাবে সাহায্য করতে দেহব্যবসাকে পেশা করেছিলেন ছবি দাস। এখন তাঁর ৫০ বছর বয়স। এই ব্যবসার পক্ষে এই বয়সটা অনেক বেশি। তবু এখনও কালীঘাটে থাকা ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই তাঁর। বয়স বেড়ে গেলে যৌনকর্মীরা অন্য পেশায় চলে যান। ঘর মোছা, বাসন মাজা, রান্নার কাজ করা ছাড়াও কেউ কেউ হয়তো গণিকালয়ের ম্যানেজার, এমন কি মালকিনও হয়ে যান।

‘মা, আমাকে বাঁচাও’

সমাজে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলার আগেই কোনও মেয়ে তার মুক্তির পথ বার করে নিতে পেরেছে, এমন ঘটনা প্রায় বিরল। কিন্তু সম্ভাবনাপূর্ণ কোনও খবর পেয়ে যখন পুলিশ খুব দ্রুততার সঙ্গে কাজ করে, তখন তারা একটি মেয়েকে দুর্ভাগ্যের কবল থেকে মুক্তি দিতে পারে । সে রকমই ঘটেছিল মালার ক্ষেত্রে, ২০১৭ সালের এপ্রিলে ১৮ বছর বয়সে দিল্লির দক্ষিণ-পূর্বের শহর আগ্রার একটি গণিকালয়ে বিক্রি হয়ে এসে ওঠার কিছুদিন পরে। মালা, তার মা এবং তদন্তকারী অফিসারদের ইন্টারভিউয়ের উপর ভিত্তি করেই এই বিবরণ।

সেখানে এসে ওঠার কয়েকদিন পরে মালা তার ঘরে আসা এক খদ্দেরকে তার সেলফোনটা ব্যবহার করতে দিতে রাজি করায়। সেখান থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক গ্রামে তার মাকে ফোন করে মালা বলেছিল, “আমি একটা খারাপ জায়গায় আছি। মা, তুমি আমাকে বাঁচাও,এখান থেকে নিয়ে যাও আমাকে।”

তার মা ইতিমধ্যেই স্থানীয় পুলিশের কাছে নিখোঁজ ডায়েরি করিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে মথুরাপুর থানায় ছুটে গিয়ে যে নম্বর থেকে মালা ফোন করেছিল, সেটি তিনি পুলিশকে জানান। তদন্তকারীরা জানতে পারেন, ফোন নম্বরটি আগ্রার একটি লোকের, যে পরে পুলিশকে ওই গণিকালয় চিনিয়ে দিয়েছিল।

প্রায় ছ’ সপ্তাহ পরে একশোরও বেশি পুলিশ অফিসার, তাঁদের অনেকেই সাধারণ পোশাকে, গণিকালয়টি যে লালবাতি এলাকায়, সেখানে উপস্থিত হন। মালা যে লোকটির ফোন ব্যবহার করেছিল, সে-ই তদন্তকারী অফিসার প্রবীর বলের নেতৃত্বে থাকা পুলিশের দলটিকে ওই বাড়ি অবধি নিয়ে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিয়েছিল। চেনামুখের খদ্দের দেখে সেখানকার কর্মচারীরা ভিতরে আসতে দিয়েছিল তাঁদের। বল এবং তাঁর দুই সহকর্মী এসেছিলেন খদ্দের সেজে। মালা যে এই বাড়িতেই আছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর তাঁরা ফোনে খবর দেন বাইরে অপেক্ষমাণ উদ্ধারকারী দলটিকে।

a woman wearing a pink dress, silhouetted by the light of the room, peers around a wall

দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসিন্দা মালাকে ২০১৭ সালের এপ্রিলে ভারতের আগ্রার একটি গণিকালয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল। তখন তার বয়স ১৮ বছর। এক খদ্দেরের মোবাইল ফোন থেকে কোনওমতে সে তার মা-কে ফোন করে। তার পরে সে কোথায় আছে, তা চিহ্নিত করে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। মালার দেওয়া পাচারকারীদের চেহারার বর্ণনার সঙ্গে মিলিয়ে তদন্তকারীরা বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছিল। বিয়ে করে মালা এখন সংসারী। শ্বশুরবাড়ি তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল। মালার কথায়, “ওঁরা ভাল মানুষ। আমার একটা ভয়ানক অতীত থাকা সত্ত্বেও আমি যে রকম, সে রকম ভাবেই আমাকে গ্রহণ করেছে ওঁর পরিবার।”

যখন বল এবং তাঁর সহকর্মীরা বাইরে থাকা অফিসারদের সঙ্গে একযোগে কাজ শুরু করার জন্য অপেক্ষা করছিলেন, তখনই গণিকালয়ের কর্মীরা কী ভাবে যেন আঁচ করে ফেলে যে একটা পুলিশি হানা হতে চলেছে সেখানে। “ওদের খাটের নীচে বাঙ্কার করা আছে, সেখানে মেয়েদের ঢোকাচ্ছিল।এমনকি, আমাদেরও লুকিয়ে পড়তে বলে ওরা,” অফিসার বল জানিয়েছেন। শেষে পুলিশ মালা-সহ পাঁচ নাবালিকা এবং ছ’জন যুবতীকে সেখান থেকে উদ্ধার করে।

যে ছেলেটি তাকে দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে পাচার করে নিয়ে এসেছিল, তার চেহারার বিবরণ মালা পুলিশের কাছে দিয়েছিল। সে জানিয়েছিল, ছেলেটির সামনের একটি দাঁত অল্প ভাঙা, হাতে আছে একটি নীল পাথর বসানো ব্রেসলেট এবং তার বাঁ হাতে হৃৎপিণ্ডের একটি ট্যাটু করা আছে। বল জানিয়েছেন, মালা তাঁদের বলেছিল ওই যুবকটি দিল্লিতে তার দিদির বাড়িতে বেশ কয়েকবার তাকে ধর্ষণ করেছে। আগ্রার যৌনপল্লিতে বিক্রি হওয়ার আগে সেই বাড়িতেই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মালাকে। তাকে বিক্রি করেছিল যুবকটির দিদি এবং দিদির স্বামী। জুলাই, ২০১৭ তারিখে পুলিশ অভিযুক্ত ফরাক আলি গায়েনকে দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে গ্রেপ্তার করে। মালার দেওয়া বিবরণের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল ২৩ বছর বয়সি শীর্ণকায় ছেলেটির চেহারা।

মালা ছেলেটির বোন এবং তার স্বামীরও চেহারার বর্ণনা দেওয়ায় পুলিশ তাদের স্কেচ আঁকিয়েছিল। বেশ কয়েক মাস পরে দিল্লিতে গ্রেপ্তার হয় মুসলিমা গায়েন, যাকে সবাই পিঙ্কি নামে চিনত এবং তার স্বামী, রাধিয়া গুপ্তা। গায়েন, তার বোন এবং ভগ্নিপতির আইনজীবী কিছু বলতে চাননি।

মথুরাপুর থানায় বসে মালাকে উদ্ধার করতে সাহায্য করা শক্তি বাহিনীর ঋষি কান্ত এবং ফোটোগ্রাফার স্মিতা শর্মাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে গায়েন জানিয়েছে কী ভাবে সে মেয়েটিকে ফাঁদে ফেলেছিল। গায়েন বলেছে, একটি মোবাইল ফোন রিচার্জ করার দোকান থেকে মালার নম্বর পেয়ে সে ফোন করে বন্ধুত্ব জমায় তার সঙ্গে। এরপর একসময় তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে মালা একদিন এসে ওঠে দিল্লিতে গায়েনের বোনের বাড়িতে।

গায়েন জানিয়েছিল, মালাকে পাচারের জন্য তাকে ২০,০০০ টাকা অর্থাৎ প্রায় ২৬০ ডলার দেওয়া হয়েছিল। সে বলেছে, বোনের কাছে এক একটি মেয়েকে নিয়ে আসার জন্য এই পরিমাণ টাকাই সে পেত। দেড় বছরে সে এবং তার শাকরেদরা ১১টি মেয়েকে পাচার করেছে।

three people sitting in a police office having a conversation

মালাকে যে যুবকটি পাচার করেছিল তার নাম ফরাক আলি গায়েন। মালার দেওয়া বর্ণনার ভিত্তিতে তাকে ২০১৭-র জুলাইয়ে গ্রেফতার করে পুলিশ। দক্ষিণ ২৪ পরগণার মথুরাপুর থানায় শক্তি বাহিনীর পাচার প্রতিরোধকারী সদস্য জগদীপ সিং রাওয়াত এবং পুলিশ অফিসার শিবেন্দু ঘোষের মাঝে দাঁড়িয়ে ফরাক। তার কাছ থেকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পরে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল মালা। ফরাক বলেছে, দিল্লিতে তার বোনের কাছে মেয়েদের নিয়ে যেত। সে জন্য প্রতি মেয়ে পিছু প্রায় ১৯,০০০ টাকা করে পেত সে। মেয়েদের তার বোন বিক্রি করে দিত যৌনপল্লিতে। সঙ্গীদের সাহায্যে দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে দেড় বছরে ১১টি মেয়েকে সে পাচার করেছে। ফরাক এবং তার সঙ্গীরা এখনও পুলিশ হেফাজতে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা চলছে।

আমার কাছে যখন মালা নিজের সব কথা বলছিল, তখন আমি উপলব্ধি করলাম, সমস্ত বাধা অতিক্রম করতে কতটা সাহস তাকে সঞ্চয় করতে হয়েছিল। আমাকে মালা জানিয়েছিল, একবার যখন গণিকালয়ের মালকিন আর কর্মচারীরা সবাই ঘুমিয়ে ছিল, সেই সময় সে সেখান থেকে পালাতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দরজা খোলার সময় তাদের একজন দেখে ফেলে।

মালা বলেছিল, “অন্য মেয়েরা কেউ পালানোর চেষ্টা করতে চাইত না, ভয় পেত যে, মারধর করা হবে।আমি বলতাম, আমি পালাব। আমি মারধর সহ্য করব, তবু আমি এখান থেকে পালাব।”

বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর মালা একটি যুবককে বিয়ে করে। ছেলেটির বিশ্বাস ছিল, যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মালাকে যেতে হয়েছে, তার জন্য তাকে দোষারোপ করা অথবা গঞ্জনা দেওয়া উচিত নয়। এই দম্পতির এখন একটি শিশু সন্তান আছে। সকলে একসঙ্গে মালার পরিবারের সঙ্গেই থাকে।

আমি আর কত কাঁদব: সায়েদা

যে সময় আমি সায়েদা এবং অঞ্জলির সঙ্গে ‘স্নেহ’তে দেখা করেছিলাম, তখন ওদের বয়স ছিল ১৭। ’সংলাপ‘ পরিচালিত মেয়েদের এই আশ্রয়টি কলকাতার দক্ষিণ উপকণ্ঠ মফস্‌সল নরেন্দ্রপুরে। এক সময় কলকাতারই একটি ইংরেজি দৈনিকে ক্রাইম রিপোর্টার হিসেবে কাজ করতাম। শান্ত পরিবেশের মধ্যে এই হোমটি। উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা সবুজ জমির উপর ছোট ছোট কতকগুলি বাড়ি, সেখানে যে কোনও সময় ৮০ থেকে ৯০টি মেয়ে থাকে। এখানে যৌনপল্লি থেকে উদ্ধার করে আনা মেয়েদের থাকতে দেওয়া হয়। তবে যৌনকর্মীদের মেয়েদের মতো যে সব নিরুপায় মেয়েরা বাধ্য হয়ে দেহ ব্যবসায়ে চলে যেতে পারে, তারাও থাকে এখানে। যাতে সমাজে ফেরার পথটা একটু সহজ হয়, সেই উদ্দেশ্যে এখানে এই মেয়েদের কাউন্সেলিং করানোর পাশাপাশি, কাপড় ছাপানো অথবা দর্জির কাজের মত বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেওয়া হয়।

যেদিন আমি যাই, তার অল্প ক‘দিন আগেই আরও ১০টি মেয়ের সঙ্গে সায়েদা এবং অঞ্জলিকে মহিষাদলের যৌনপল্লি থেকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছিল। তাদের কাছে ’সংলাপ‘-এর কর্মীরা জানতে চেয়েছিলেন আমার সঙ্গে তারা দেখা করতে চায় কি না। সকলেই রাজি হয়েছিল। মেয়েদের দেখাশোনা করার দায়িত্বে থাকা একজন অভিভাবক স্থানীয় মহিলা তাদের নিয়ে এলেন একটি বড় সাদামাটা ঘরে। সেখানে আমি ’সংলাপ‘-এর এক প্রতিনিধির সঙ্গে অপেক্ষা করছিলাম।দরজার কাছে জুতো ছেড়ে সার দিয়ে তারা ঘরে ঢুকল। ততক্ষণে সতর্ক চোখে আমাকে দেখে নিজেদের মধ্যে গল্প থামিয়ে দিয়েছে তারা। অবশ্য এর পরে মেঝেতে শতরঞ্চি বিছোনোর জন্য আমি হাত লাগাতে ওদের অস্বস্তি ভাবটা কেটে গেল। আমরা সকলে গোল হয়ে বসলাম। এর পরে বাংলায় কথাবার্তা শুরু হতে মেয়েদের আচরণ আরও সহজ হয়ে গেল। বাড়িতে আমিও বাংলা ভাষায় কথা বলেই বেড়ে উঠেছি।

ওদের বোঝালাম যে, আমি যৌন ব্যবসার জন্য নারীপাচার নিয়ে লিখছি এবং কী অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পাচার হওয়া মেয়েদের যেতে হয়, তা বুঝতে চাই। এ কথাও পরিষ্কার বললাম যে, আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ব্যাপারে ওদের কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। কথা বলার ব্যাপারে সবচেয়ে উৎসাহী ছিল আমার ডান পাশে বসা সায়েদা। ওর দুষ্টু চোখ, ঝকঝকে হাসি আর একটা সহজ আত্মবিশ্বাসের জন্য সে অন্যদের থেকে আলাদা করে চোখে পড়েছিল।যখন জানতে চাইলাম কী ভাবে সে যৌনপল্লিতে পৌঁছে গিয়েছিল, তখন খুব সহজ গলায় সায়েদা বলে, যে ছেলেটিকে সে ভালবেসেছিল, সে-ই তাকে ধোঁকা দিয়ে নিয়েগিয়েছিল। আমাকে সে জানাল গণিকালয়ের লোকেরা মেয়েদের উপর কী রকম কড়া নজর রাখত, আর কী ভাবে ভক্ত, সেখানকার মালিক, তাকে আর অন্য মেয়েদের পেটাত। সায়েদার পাশে বসা অঞ্জলি বলেছিল, “রক্ত বার না হওয়া পর্যন্ত ও (ভক্ত) থামত না।” সায়েদার কথায়, “ও আমাদের শাসাত, বলত, দিনে অন্তত ১০ জন খদ্দেরের সঙ্গে কাজ না-করলে তোদের মারব।”

two girls sitting, one brushing the hair of another, while another girl hangs laundry on a line

দক্ষিণ ২৪ পরগনায় সংলাপ-এর হোম ‘স্নেহ’তে ৮০ থেকে ৯০ জন অল্পবয়সি মেয়ে এবং মহিলার দেখভাল করা হয়। এরা হয় অত্যাচারের শিকার, না হলে এমন কেউ, যাদের বিপদের সম্ভাবনা আছে। যৌনপল্লিতে পাচার হওয়া মেয়েরা ছাড়াও যাদের নাবালিকা অবস্থায় জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল অথবা যারা গার্হস্থ্য হিংসার শিকার— তারাও আছে এখানে। ‘স্নেহ’ থেকে এদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা ছাড়াও কাউন্সেলিং করানো হয়। দেওয়া হয় দর্জির কাজের মতো কিছু বৃত্তিমূলক শিক্ষাও, যাতে তারা নিজেদের জীবন আবার গড়ে তুলতে পারে।

অঞ্জলির কথা জানতে চাইলে সে বলে, কেমনভাবে তার প্রেমিক তাকে পাচার করেছিল। “ও আমাকে বিয়ে করবে বলে এনেছিল,” নিজের অতি সরলতার জন্য অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হেসে সে বলল। এ কথা শুনে হেসে উঠল অন্য মেয়েরা। সেই সময় তাদের এই হাসিকে নিষ্ঠুরতা মনে হলেও কথাবার্তা আরও গড়াতেই বুঝতে পারলাম, ওরা অঞ্জলির বোকামি নিয়ে হাসেনি, কারণ ওদের সকলের অভিজ্ঞতা একই!

গণিকালয়ে বন্দি মেয়েদের কয়েকজন অবশ্য পালানোর দুর্বল প্রচেষ্টা করেছিল। অঞ্জলি আমাকে বলেছে, সে একবার পালানোর জন্য একজন খদ্দেদেরের সাহায্য চেয়েছিল। কিন্তু লোকটি তা অন্য একটি মেয়েকে বলে দেওয়ায় একসময় ঘুরেফিরে কথাটা যায় ভক্তর কানে। “এরপর মার খেতে হয়েছিল আমাকে,” সে বলল।

সায়েদার মতো বাংলাদেশ থেকে আসা মেয়েরা আরও অসহায় বোধ করত। ওরা অবৈধ ভাবে ভারতে এসেছে বলে ভক্ত তাদের মধ্যে এই ধারণাই ঢুকিয়ে দিয়েছিল যে,পতিতালয়ই তাদের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। সায়েদা আমাকে বলেছিল, “মালিক আমাদের ভয় দেখাত, বলত, পালাবি তো? চেষ্টা করে দেখ। পুলিশ ধরলে ঘরে ফিরতে পারবি না। যত দিনে ছাড়বে, ততদিনে বুড়ি হয়ে যাবি।”

এই মেয়েদের সঙ্গে আমার কথোপকথন যত এগিয়েছে ততই বুঝতে পেরেছি,যে বিপুল হতাশা এদের গ্রাস করেছিল, সেই হতাশা তাদের মনের কতটা গভীরে প্রোথিত তা অনুমান করা আমাদের পক্ষে কার্যত অসম্ভব। এদের একজন আমাকে বলেছে, পরিচিত একজনের সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে আসার আগে তিন মাসের শিশুকন্যাকে দেখাশোনা করার জন্য সে তার বাবাকে বলেছিল। যার সঙ্গে চলে এসেছিল, সেই লোকটি তাকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিক্রি করে দিয়েছিল যৌনপল্লিতে। বেশ কয়েক মাস বাদে তার মোবাইল ফোন ফেরত পাওয়ায় মেয়েটি এ বার কয়েকদিন পর পর বাড়িতে ফোন করে বাবার সঙ্গে কথা বলতে পারত।তাঁকে মিথ্যা বলত সে। বলত, সে একটা কারখানায় কাজ করছে, কিন্তু মালিকের কাছে ধারের টাকা শোধ না-হওয়া পর্যন্ত বাড়ি ফিরতে পারছেনা। দিন চলে যেতে থাকলে বাবা একসময় হতাশ হয়ে পড়েন। এ বার তিনি মেয়েকে ফোনে বলেন, “দু’বছর হয়ে গেল, তুই কবে আসবি? তুই তো ছ’মাসের কথা বলে গিয়েছিলি। তা়ড়াতাড়ি চলে আয়। আমি মরে গেলে তোর মেয়েকে কে দেখবে ?” মেয়েটি এ ভাবেই তার বাবার বলা কথাগুলি আমাকে বলেছিল।

এ বার মেয়েটি তার বাবাকে বলে তার মালিকের সঙ্গে কথা বলতে। ভক্তকে ফোনটা দিতে তার বাবা মেয়েকে বাড়ি আসতে দেওয়ার জন্য অনুনয় করেন। তাতে ভক্তর মন ভেজেনি। উত্তরে সে সব সময়ই বলেছে, মেয়েকে আরও কয়েক মাস এখানে কাজ করতে হবে। এরপর একদিন বাবা আবার ফোন করেন এবং মেয়েকে বলেন যে, তার বাচ্চাটি মারা গিয়েছে। “দু’দিন ধরে আমি শুধু কেঁদেছি,” মেয়েটি বলেছিল। এর পরে একসময় তার বোনের সঙ্গে কথা বলে সে জানতে পারে বাচ্চা মারা যায়নি। মরিয়া হয়ে তার বাবা মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁর আশা ছিল, এতে ভক্তর মন একটু গলবে, মেয়েকে বাড়ি আসতে দেবে।

a group of hands on concrete all with red nailpolish
a folded dress, comb, toothbrush, underwear and other items lying on a lace cloth
প্রথম ‘স্নেহ’র মেয়েরা রাঙিয়েছে নিজেদের হাতের নখ। পাচার হওয়া এবং যৌনদাসত্বের জন্য বিক্রি হয়ে যাওয়ার তীব্র মানসিক আঘাতের অভিজ্ঞতা এদের প্রায় সকলেরই। তাই পরিজনের কাছে ফিরে যাওয়ার আগে এদের অনেকের মধ্যেই নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে।দ্বিতীয় কোনও নির্যাতিতা ‘স্নেহ’ তে এলে তাকে প্রথমেই ব্যাগে করে একটি গামছা, এক প্রস্থ পোশাক ও অন্তর্বাস দেওয়া হয়। এছাড়াও নিত্য ব্যবহার্য অন্যান্য ব্যক্তিগত জিনিস দেওয়া হয়ে থাকে। এগুলি দেওয়া হয় এই কারণেই, যাতে মেয়েরা মনে করে কেউ তাদের খেয়াল রাখছেন। যে সম্মান আর মর্যাদা তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, তা ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে একটি ছোট পদক্ষেপ।

পরের দিন সকালে আবার যখন মেয়েদের কাছে যাই, তখন জানতে চাই সায়েদা আর অঞ্জলি আর এক বার আমার সঙ্গে কথা বলবে কি না, কারণ আমার এই কাজে ওরাই সবচেয়ে বেশি সহায়তা করত পারত। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। আকর্ণ হাসি নিয়ে সায়েদা উপস্থিত—ওর কপাল-গাল লাল-নীল-সবুজ আবীরে রঙিন।দিনটা ছিল হোলির ঠিক পরেই। এই উৎসবে লোকে একে অন্যেকে রং মাখিয়ে আনন্দ করে।জানতে পারলাম, ওই সকালে সায়েদা হোমের অন্য মেয়েদের কাছ থেকে মহা আনন্দের সঙ্গে পুরো মুখটাকে রাঙিয়েছে। তবে অঞ্জলি অল্প রঙ মেখেই পার পেয়ে গেছে।

এরপর এই দু‘জন নির্লিপ্ত ভাবে আমাকে তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছিল। আমাকে বাকরুদ্ধ করেছিল তাদের সেই অসামান্য নির্লিপ্ততা।

যৌন নিগ্রহ নিয়ে বেশি কিছু বলতে চায়নি ওরা। বরং শুনিয়েছিল তাদের উপর অমানবিক শারীরিক নির্যাতনের কাহিনি। অঞ্জলি তার ঠোঁটে একটি পুরনো ক্ষত দেখিয়ে বলেছিল, ওটা ভক্তর সিগারেটের ছ্যাঁকার দাগ। সায়েদা আমাকে বলেছে, অনেক সময় ভক্ত একটি মেয়েকে মারার জন্য অন্য একটি মেয়েকে হুকুম করত। মারা হত বেল্ট অথবা লাঠি দিয়ে। ভক্ত দেখত।

এই অত্যাচার সহ্যের অনুভূতি কেমন, সে বর্ণনা দেওয়ার জন্য কী ভাবে সায়েদাকে প্রশ্ন করব, আমি বুঝে উঠতে পারিনি। তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিন বছর ধরে এই রকম একটা জীবন কাটানোর সময় সে কতটা চোখের জল ফেলেছে। বলেই অবশ্য মনে হল প্রশ্নটা অবান্তর শোনাচ্ছে। “কান্না তো বহুত করেছি! আর কান্না?” যে রকম আত্মসমর্পণের সুরে কথাটা সে বলেছিল, তা আমি এত অল্পবয়সি কারুর মুখ থেকে কখনও শুনিনি। তবে বুঝতে পারলাম, চোখের জল দিয়ে তার দুঃখকে পরিমাপ করা যাবে না।

সায়েদা আমাকে বলেছিল কেমন করে সে শুধু মদ খেয়ে ব্যথা ভোলার চেষ্টা করত। সেই সময় অঞ্জলি জানাল, মত্ত অবস্থায় সায়েদা প্রায়ই এর-তার সঙ্গে মারামারিতে জড়িয়ে পড়ত। অঞ্জলি বলেছে,অনেক সময় সায়েদা কাঁদত আর অন্য মেয়েদের জানাত, তার পরিবারের জন্য কতটা মন কেমন করছে। .

two girls facing away from the camera holding hands

দুই বোন, ‘জ’ এবং ‘ব’ এখন প্রাপ্তবয়স্ক। তাঁরা যখন সদ্য কৈশোরে, তখন তাঁদেরই এক আত্মীয় ঢাকা থেকে মহিষাদলের এক গণিকালয়ে পাচার করে দিয়েছিল। ১৫ বছর বয়সে অন্তঃসত্ত্বা হন ‘ব’। তাঁকে জোর করে গর্ভপাত করানো হয়েছিল। অনেক সময়ই ‘ব’ খদ্দেরদের সঙ্গে যৌনমিলনে রাজি হতেন না। তখন গণিকালয়ের মালিক তাঁর বোনের হাতে বেল্ট তুলে দিত তাঁকে (‘ব’) পেটানোর জন্য। ‘জ’-এর কথায়, “দিনে ২০ জন খদ্দেরের সঙ্গে শোওয়ার চেয়েও বেশি যন্ত্রণার ছিল এটা।’’

ওদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বাড়ি ফিরে কী করবে? অঞ্জলি অঞ্জলির কাছে এ ব্যাপারে কোনও সদুত্তর ছিল না।

“তুই কি আবার প্রেম করবি?” হাসতে হাসতে সায়েদা জিজ্ঞাসা করেছিল।

“না, আর প্রেম করবো না,” অঞ্জলি উত্তর দিয়েছিল।

“বাড়ি গেলে আমি আল্লাহ্‌র নাম করে কোরান শরিফ শিখব,” সায়েদা বলেছিল। সে আরও বলেছিল, আগে সে যেখানে কাজ করত, সেই বিউটি পার্লারে আবার কাজ নেওয়ার চেষ্টা করবে। আর বলেছিল, “নাচে ফিরে যাব না। পড়াশোনা শিখব।”

“আমি নাচে ঢুকে যাব,” বলেছিল অঞ্জলি। সায়েদার সাবধান বাণী, “না, নাচে ঢুকিস না রে, আবার আমার মত বিপদে পড়ে যাবি।”

যখন আমরা সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাইরে চলে এসেছি, তখন সায়েদা আমাকে জিজ্ঞাসা করল আমার সেলফোনে ওর শহরের স্যাটেলাইট ছবি দেখা যাবে কি না। একটি নাম করা মসজিদের পাশে, যেখানে ওর বাবা-মা থাকেন, সেই জায়গাটা ও আমাকে দেখাতে চেয়েছিল। আমার ফোন থেকে সেটা অবশ্য আমি করতে পারিনি, তবে সায়েদাকে কথা দিয়েছিলাম যে, তার পরিবারের কাছে সে ফিরে যাবার পর অবশ্যই একবার আমি খুলনায় গিয়ে ওকে দেখে আসব।

এক গাল হেসে সায়েদা আশ্রয়ের সামনের একটা খেলার মাঠে দৌড়ে চলে গেল। দেখতে পেলাম একটা স্লিপের উপর চড়ে তারপর পিছলে নামছে সে। গাড়ির দিকে এগোতে এগোতে কানে গেল ওর হাসির শব্দ।

হাল ছাড়ি না আমরা: পাচার-বিরোধী কর্মী

দু’বছর আগের এক বিকেলে হলদিয়ার আইনজীবী গিরিরাজ পাণ্ডা, যিনি যৌন ব্যবসার জন্য পাচারের মামলা দায়ের করতে সাহায্য করেছেন, আদালতের কাছেই রাস্তার একটি দোকানে মধ্যাহ্নভোজ সারছিলেন। চারিদিকে রোজকার কাজের পরিচিত শব্দ ছাপিয়ে হঠাৎ একটা গোলমালের আওয়াজ এল কানে। পাণ্ডা তাকিয়ে দেখলেন, একটি লোক তির বেগে দৌড়চ্ছে আর তার পিছনে ধাওয়া করেছেন জনা দুয়েক পুলিশ। তবে উর্দিধারীরা অনেক আস্তে দৌড়চ্ছিলেন। দৌড়ে তাদের হারিয়ে দিয়ে লোকটি এক সঙ্গীর মোটরবাইকে চড়ে বসল, তারপর হাওয়া বেপাত্তা।

ভক্ত ও তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে এবং উদ্ধার হওয়া মেয়েদের পক্ষে ’সংলাপ‘-এর হয়ে কাজ করেছিলেন পাণ্ডা। পালিয়ে যাওয়া লোকটিকে চিনতে পারলেন তিনি। ওই পলায়মানটি ভক্ত। সে দিন আদালতে তার হাজিরার দিন ছিল। তার হাত ধরে সেখানে নিয়ে যাওয়ার সময় ভক্ত পুলিশের হাত ছাড়িয়ে পালায়। পাণ্ডা জানিয়েছেন, একই অভিযোগে এর আগেও কোর্টে আসতে হয়েছে ভক্তকে, কিন্তু আইনজীবীরা তার জামিনে ছাড়া পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এ বার বেপরোয়া ভাবে পালিয়ে ভক্ত একটা বড় ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছে, কারণ নতুন অভিযোগ থেকে তখনও সে মুক্তি পায়নি। এর মধ্যে দেড় বছর জেলে কাটানো হয়ে গেছে গণিকালয়ের এই মালিকটির।

গণিকালয়ের মালিক-মালকি ন এবং পাচারকারীরা, যারা নাবালিকাদের নিজেদের লাভের জন্য শোষণ করে, তারা যে প্রায়শই অপরাধ করেও পার পেয়ে যায়, তা আইন প্রয়োগে পুলিশের ব্যর্থতার জন্য শুধু নয়, ভারতীয় আইন ব্যবস্থার মধ্যেও নিষ্কৃতির অনেক পথ খোলা রয়েছে। ভারতের আদালতগুলিতে জমে থাকা মামলার সংখ্যা এত বিপুল যে, বছরের পর বছর একটি মামলা গড়ানো মোটেই অস্বাভাবিক নয়। বহু ক্ষেত্রেই অযোগ্যতা অথবা দুর্নীতির কারণে বাদীপক্ষের সময়ের মধ্যে চার্জ গঠন করতে না-পারার জন্য অভিযুক্তদের জামিন মঞ্জুর না করে উপায় থাকেনা আদালতের।

পাণ্ডা আমাকে বলেছিলেন, “পাচার মামলায় সাজা এড়াতে বিবাদী পক্ষ অর্থ এবং পেশিশক্তি ব্যবহার করে। বহু টাকা খরচ করে আদালতে আইনজীবী দাঁড় করায়। এ ব্যাপারে কয়েক কোটি টাকা ঢালতেও তারা পিছপা হয় না।” সাক্ষীদের ভয় দেখানো কিংবা ঘুষ দেওয়া অতি সাধারণ কৌশল। কোনও যৌনপল্লিতে হানা দিয়ে মেয়েদের উদ্ধার করার পর মামলা করার ক্ষেত্রে প্রথম কাজগুলির মধ্যে একটি হল, উদ্ধার করা নিগৃহীতারা শপথ নিয়ে একটি লিখিত বিবৃতি দেবে। এরপর আদালতে মামলা উঠলে যখন মেয়েদের নিয়ে আসা হয়, তখন সেখানে অভিযুক্তের পোষা গুন্ডাদের দেখা পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। তারা মেয়েদের ভয় দেখায়। যদি কাছে আসতে না-ও পারে, দূর থেকেই চোখরাঙায় অথবা শরীরী ভঙ্গি দিয়ে ভয় পাওয়ানোর চেষ্টা করে। ওই আইনজীবীর কথায়, “পাচার করা মেয়েরা যদি বাংলাদেশ অথবা নেপালের হয়, তা হলে গুন্ডারা সাবধান করে দেয়, ‘এই একদম বলা যাবে না। তা হলে তোদের আর বাংলাদেশে পাঠাবো না। আর কোনও দিন দেশে ফিরতে পারবি না।’”

many woman sitting on the floor looking up toward the front of the room

কালীঘাটের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘নিউ লাইট’-এর বার্ষিক অনুষ্ঠানে যৌনকর্মী এবং সেখানকার কর্মচারীরা। এই সংস্থার পক্ষ থেকে যৌনকর্মীদের ছোট সন্তানদের দেখাশোনা এবং স্কুলে পড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। এলাকার নিষিদ্ধপল্লিগুলিতে ছোট মেয়েদের দিয়ে দেহব্যবসা রুখতে যৌনকর্মীদের ইউনিয়নের সঙ্গে এক সঙ্গে কাজ করে এই সংস্থা।

জামিনে মুক্তি পাওয়া অভিযুক্তরা ভয় দেখানো চালিয়ে যায়। মেয়েদের পরিবারগুলির উপর জোরজুলুম করে তারা। এরপর পরিবারের চাপে পড়ে পাচার হওয়া মেয়েরা অনেক সময় বিচার চলাকালীন তাদের প্রাথমিক বিবৃতি প্রত্যাহার করে কিংবা সেটি অনেক পুরনো বলে দাবি করে। দুর্বল তদন্তের ফলে দোষ প্রমাণ করার উপযুক্ত কাগজপত্র হাতে না আসার জন্য বিচারপ্রক্রিয়া ব্যাহত হয়, বলেছেন অঙ্কিতা চক্রবর্তী, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি, খড়গপু্র, পশ্চিমবঙ্গের একজন ডক্টরাল ছাত্রী। তাঁর পিএইচডি থিসিসের জন্য ভারতে নারী পাচারের মামলাগুলির বিশ্লেষণ করছেন তিনি।

অঙ্কিতা বলতে থাকেন, “ধরুন একটা গণিকালয়ে রেড করা হল। কিন্তু কে তার মালিক, তা প্রমাণের জন্য বিদ্যুতের বিল অথবা সেই জাতীয় কিছু জোগাড় করা গেল না। খোঁজ নিয়ে এমন ঘটনাও পেয়েছি, যেখানে পুলিশ পাচার-বিরোধী অথবা শিশু-সুরক্ষা আইন অনুযায়ী মামলা না-করে ইন্ডিয়ান পিনাল কোডের এমন ধারায় অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মামলা করেছে, যাতে সহজেই জামিন মঞ্জুর হয়ে যায়। ফলে বেশিরভাগ অপরাধীরা মামলাতেই ছাড়া পেয়ে যায়।”

এই ভয়ানক অবস্থা সত্ত্বেও পাচারকারীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার প্রচেষ্টা বন্ধ হয়নি। মালাকে পাচার করার অভিযোগে অভিযুক্তদের দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বিচার চলছে। এই মামলায় বাদীপক্ষের আইনজীবী দেবরঞ্জন ব্যানার্জি আমাকে বলেছেন, মামলা ভেস্তে দিয়ে যাতে অভিযুক্তদের জামিন পাওয়ানো যায়, তার জন্য পাচারকারীদের হয়ে কাজ করা লোকজন তাঁকে ঘুষ দিতে চেয়েছিল। প্রথম কয়েকটি শুনানির সময় পাচারকারীদের চেলারা আদালত চত্বরে হাজির হয়েছিল-তাদের কয়েকজনের জিনসের ভিতর গোঁজা ছিল আগ্নেয়াস্ত্র। “উদ্দেশ্যটা ছিল আমাকে ভয় দেখানো,” দেবরঞ্জন বলেছেন। এরপর তিনি অনুরোধ করলে পুলিশ নিরাপত্তা বাড়ায়। এ ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের জামিন হয়নি।

আইনজীবী পাণ্ডা জানিয়েছেন, গত ছ’বছরে তিনি এবং তাঁর দলের সদস্যরা হলদিয়া অঞ্চলে ১২টির বেশি পাচারের মামলায় অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত করাতে পেরেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ভক্তর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলি প্রমাণের জন্যেও তিনি লড়বেন। পুলিশ হেফাজত থেকে পালিয়ে যাওয়ার কয়েক সপ্তাহ বাদে তাকে খুঁজে বার করে আবার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

মামলাটি এখনও চলছে এবং হয়তো আরও কয়েক বছর ধরে চলবে। ভক্ত এই বছরের শুরুর দিকে জামিন পেয়েছে। তবে পাণ্ডা জানিয়েছেন, এর বিরুদ্ধে আবেদন করা হবে। পাচারকারী এবং গণিকালয়ের মালিকেরা মামলার জন্য অনেক খরচ করতে পারে, তাই তাদের রেহাই পাওয়াও সহজ হয়। “যেহেতু এদের পয়সা আছে, তাই এদের বেরিয়ে যাওয়ার অনেক সুযোগ আছে। কিন্তু আমরাও ছাড়ব না,” তিনি বললেন।

‘আমার মেয়েটাই আমার পৃথিবী ছিল’

‘স্নেহ’তে আমি যাওয়ার কয়েক মাস বাদেই সায়েদার পেটে অসহ্য ব্যথা শুরু হয়। তার অল্প ক’দিন আগেই আশ্রয়ের একটি অনুষ্ঠানে নেচেছিল সে। অবস্থা এত খারাপ ছিল যে, সে খেতে পারছিল না। তার পেট ফুলে গিয়েছিল, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল।‘স্নেহ’র কর্মীরা তাড়াতাড়ি তাকে হাসপাতালে ভর্তি করালেন। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পরেই মারা গেল সে। ডাক্তারেরা জানিয়েছিলেন, লিভার কাজ না-করার জন্যই সায়েদা মারা গিয়েছে। খুব সম্ভবত অত্যধিক মদ্যপানের জন্যই এই পরিণতি।

খবরটা আশ্রয়ের অন্য মেয়েদের সাঙ্ঘাতিক আঘাত করেছিল, বিশেষত অঞ্জলিকে। “খুব কেঁদেছি আমরা,” অঞ্জলি আমাকে বলে। কী রকম ভাবে সায়েদা অন্য সবাইকে হাসাত, সে কথা বলে অঞ্জলি বলেছিল, “শেষ একবার ওকে দেখার ইচ্ছে ছিল।” কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। সায়েদার নিথর শরীরটা একটা ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বেনাপোলে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ওপারে, যেখানে তার বাবা অপেক্ষা করছিলেন। আমি শুনেছি, সায়েদার কফিন যখন তার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য অন্য একটি ভ্যানে তোলা হচ্ছিল, তখন মানুষটি নীরবে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সেখানে।

a woman lies in with her head on her mothers lap on a bed
a diary with window shadow markings
প্রথম উদ্ধার হয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাড়িতে ফেরার দিনকয়েক পর ‘চ’-কে সান্ত্বনা দিচ্ছেন তার মা। সবে প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে মেয়েটি। তার ডায়েরি দেখে পরিবার বুঝতে পেরেছিল একটি ছেলের সঙ্গে পালিয়েছে সে। বেশ কয়েক মাস পরে পুণের একটি যৌনপল্লি থেকে পুলিশ তার সন্ধান পায়।দ্বিতীয় ‘চ’- এর ডায়েরি। এক ঝলক দেখলেই বোঝা যায়, কিশোরী মন মোহে কতটা অন্ধ ছিল। সেই মানসিক অবস্থাকেই কাজে লাগিয়েছিল ‘চ’-এর পাচারকারী : “তোমাকে আমার জীবনে না-পেলে আমি মরে যাব। তোমার না হতে পারলে আমি আর কারও হতে পারব না।”

নভেম্বর, ২০১৮তে ফোটোগ্রাফার স্মিতা শর্মাকে নিয়ে খুলনায় সায়েদার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। বেশ আনন্দের হবে এই যাওয়া— এমনটাই একসময় কল্পনায় ভেবেছিলাম সায়েদা আর আমি। সায়েদা যে মসজিদটা আমাকে দেখাতে চেয়েছিল, তার পাশ কাটিয়ে, রাস্তার একটা চায়ের দোকানের পাশে গাড়ি দাঁড় করানো হোল। সালওয়ার কামিজ পরা, খাটো এবং শক্তপোক্ত চেহারার সায়েদার মা আমাদের একটা অপরিচ্ছন্ন রাস্তা দিয়ে নিয়ে গেলেন তাঁদের বাড়িতে। সেখানে সায়েদার বাবা, রোগা, ক্লিষ্ট চেহারার একটি মানুষ, নিস্তেজ ভাবে স্বাগত জানালেন আমাদের। বাইরের ঘরটায় কোনও আসবাব না-থাকায় আমাদের শোওয়ার ঘরে বসতে দেওয়া হয়। সেখানে বিছানার উপর স্মিতা আর আমি পায়ের উপর পা আড়াআড়ি রেখে বসেছিলাম। জানলা দিয়ে দুপুরের আলো ঢুকছে তখন সেই ঘরে।

এখানেই সায়েদা তার ছোটবেলার বেশি সময়টা কাটিয়েছিল। তার মা আমাকে বললেন, সায়েদার কফিনটা যখন তার বাবা বাড়িতে নিয়ে আসেন, বাইরে তখন অনেক শোকার্ত মানুষের ভিড়। “আপনি এখানকার বাজারে যাবেন, সবাই ভাল বলবে ওর সম্পর্কে,” তিনি বললেন। সায়েদা গাইতে আর নাচতে কত ভালবাসত, সে কথা আমাকে বলতে আমি মাকে মেয়ের একটা ছবি দেখাই। একটা নাচের অনুষ্ঠানের পর তোলা সে ছবিতে অঞ্জলিও ছিল। উজ্জ্বল ম্যাজেন্টা রঙের একটা শাড়ি পরনে আর মাথায় সোনালি মুকুট--ঝকঝকে হাসছে সায়েদা।

ছবিটির দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলেন তার মা, তারপর কেঁদে ফেললেন, “আমার মেয়ের মনটা সরল ছিল, সে জন্যই চলে গেল মেয়েটা”, চোখের জল মুছে বললেন মহিলা।

গোটা দুয়েক অ্যালবাম, যাতে সায়েদার আরও কম বয়সের ছবি ছিল, আমাকে দেখাতে নিয়ে এলেন সায়েদার মা।“ভাল জামা কাপড় পরে যাতে সুন্দর দেখায়, তা করতে ভালবাসত সায়েদা,” তিনি বললেন। “ও যে আমার মেয়ে, দেখে মনে হত না।” গর্বিত ভাবে জানালেন প্রসাধন ব্যবহারে কী রকম দক্ষ ছিল তাঁর মেয়ে। কোনও বিয়ে বাড়ি যেতে হলে সায়েদাই প্রসাধনের কাজটা করত। সায়েদার প্রসাধনী জিনিসপত্র,শাড়ি, স্যান্ডাল সব একটা বাক্সে রাখা আছে। সেগুলি ছেড়ে থাকার কথা ভাবতেও পারেন না তিনি।মা জানালেন, সায়েদার পিছনে পিছনে সব সময় ওর থেকে ছোট ছেলেমেয়েরা ঘুরত। ওরা বাড়িতেও আসত। সেখানে তাদের বলিউডের মত করে নাচ-গান করাত সে। সে সব হয়ে গেলে তাদের বাটিভর্তি ভাত আর নিজের না-পরা জামাকাপড়গুলি দিয়ে তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিত সে।

সায়েদাকে যে পাচার করে গণিকালয়ে আটকে রাখা হয়েছিল, ওর মা-বাবা তা জানতেন। ওঁরা জানতে চেয়েছিলেন কী রকম ভাবে কাটাতে হয়েছিল তাকে। আমি তাই সায়েদার দেওয়া সাক্ষাৎকারের রেকর্ডিং চালালাম। ওর মা ঝুঁকে পড়ে শুনতে লাগলেন। পাশের ঘরে মেঝেতে বসে দেওয়ালের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে শুনছিলেন বাবা। প্রথম কয়েক মিনিট পরে, যখন সায়েদা বলতে শুরু করেছে কী সহ্য করতে হয়েছে তাকে সেই যৌনপল্লিতে, প্রবল অস্বস্তি নিয়ে ঘুরে বসলেন মা, আর বাবা মুখটা ঘুরিয়ে নিলেন।

‘কষ্ট হবে এ সব শুনলে’

সায়েদার মা আমার দিকে তাকালেন, তাঁর চোখ ভর্তি জল, বললেন “কষ্ট তো স্যার এমনিও আছে, ওমনিও আছে। কষ্টের শেষ নেই।”

সেই অপরাহ্ণে সায়েদার বাবা একটি কথাও বলেননি। ওই পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিতে পরের দিন যখন যাই, অবশেষে তখন তিনি মুখ খুললেন। বললেন,“আমার মেয়েটাই আমার পৃথিবী ছিল। ও সবসময় হাসিখুশি থাকত। সেই মেয়ে আজ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল।” একটু থামলেন, বলতে শুরু করলেন, “মেয়েটার ছবি সব সময় আমার চোখে ভাসে।” মেয়ের মৃত্যু তাঁর জীবনকে ওলোটপালট করে দিয়েছে। স্নান, খাওয়া বাদ যায় প্রায়ই, রিকশায় সওয়ারি পার না-করে মেয়ের শোক বুকে নিয়ে রাস্তার ধারে বসে থাকেন বহুক্ষণ।

সায়েদার মা আমাকে বললেন, তার বাবার ধারণা নাচের স্কুলে মেয়েকে ভর্তি হতে দেওয়াই সব সর্বনাশের মূল। মা ভেবেছিলেন সায়েদাকে যে ভাবে পাচার করা হয়েছিল সেই বিবরণ তারই মুখ থেকে শুনে হয়তো বাবা বুঝতে পারবেন যে নাচের প্রতি তীব্র ভালবাসা তার মৃত্যুর কারণ ছিল না। কী ভাবে সায়েদাকে লোভ দেখিয়ে ফুসলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তা বাবা শুনেছেন। কিন্তু তাতে তাঁর শোকার্ত মনে বসে যাওয়া ধারণা মুছে যায়নি।

hands holding up a pink sari with light gold detailing
a pair of sandals with blue straps
প্রথম বাংলাদেশের খুলনার বাড়িতে মেয়ের প্রিয় শাড়িটি নিয়ে বসে রয়েছেন সায়েদার মা। রমজানের শেষে মুসলিমদের পবিত্র পরব ঈদ আল-ফিতরে মেয়েকে শাড়িটি দিয়েছিলেন তার বাবা। সেই শেষবার মেয়ের সঙ্গে উৎসব পালন করেছিলেন বাবা-মা। ১৪ বছর বয়সে সায়েদা একটি ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যায়। সে তাকে বিক্রি করে দিয়েছিল মহিষাদলের একটি যৌনপল্লিতে।দ্বিতীয় সায়েদার পোশাক, প্রসাধনীর সঙ্গে তার প্রিয় এক জোড়া জুতোও রেখে দিয়েছিলেন মা। এই সামগ্রীগুলিই তাঁর প্রাণোচ্ছ্বল মেয়ের বেদনাময় স্মৃতিকে বহন করে। তিন বছর ধরে সায়েদাকে একটি গণিকালয়ে আটকে রাখা হয়েছিল। সেখানে তাকে মারধর করা হত এবং বাধ্য করা হত খদ্দেরদের সঙ্গে যৌনমিলনে। পুলিশি অভিযানে উদ্ধার করার পরে সায়দাকে পাঠানো হয়েছিল ‘স্নেহ’তে। কিন্তু আর কোনওদিনই তার ঘরে ফেরা হয়নি।

“নাচ না শিখলে তো আমার মেয়ে এরকম ভাবে মারা যেতনা,” তিনি বললেন। পাচারের শিকার মেয়েগুলিকে প্রায়শই দোষারোপ করা হয় এই বলে যে, এ সবের জন্য তারাই কোনও না কোনও ভাবে দায়ী। সায়েদার ক্ষেত্রে এমন কি মৃত্যু এসেও সেই দোষারোপ থেকে তাকে মুক্তি দিতে পারেনি।

‘আর কাউকে ভালবাসতে চায় না অঞ্জলি’

আশ্রয়ে দেড় বছর কাটানোর পর অঞ্জলি শিলিগুড়িতে তার মায়ের সঙ্গে থাকতে ঘরে ফেরে। একটা কারখানায় সে কাজ নেয়। ডিসেম্বর, ২০১৯-এ যখন আমি সেখানে যাই, তখন ১৯ বছরের অঞ্জলি ঘরের কাজে তার মাকে সাহায্য করছিল।

অঞ্জলি আমাকে বলেছিল বড় একাকীত্বের সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে ওকে। ‘সংলাপ’-এর সেই বন্ধুদের আর সে পাচ্ছে না। যেমন করে ওরা তার মনের যন্ত্রণা বুঝত, আর কেউ সে ভাবে বুঝবে না। তার অভিজ্ঞতার কাহিনি অঞ্জলি মা-কে খুব বেশি বলেনি। ও যে বছর দুয়েক অন্য কোথাও ছিল, প্রতিবেশীরা জানে। ওদের কেউ কেউ এটাও শুনেছে যে সে কিছু দিন একটা আশ্রয়ে ছিল। অঞ্জলি আমাকে বলল, কয়েকজন প্রতিবেশীকে এমনও বলতে শুনেছে যে, সে একটা নোংরা পেশায় ছিল। “আমি ওদের কথার কোনও উত্তর দিই না,” সে বলল।

এটা পরিষ্কার, প্রতিবেশীদের অসম্মানজনক কথাবার্তা অঞ্জলিকে আরও একা করে দিচ্ছিল। সে চেষ্টা করত কানে তুলো দিয়ে প্রতিবেশীরা চারপাশে নেই, এমনটা মনে করার। কিন্তু তাকে সবসময় পাহারা দেওয়া মায়ের আচরণ উপেক্ষা করে থাকা আরও কঠিন ছিল। দম বন্ধ লাগত অঞ্জলির।

তার মা-কে দেখে স্নেহময়ী মনে হয়। মহিলা আমাকে বলেছিলেন, মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে তিনি সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকেন। যে কারখানায় অঞ্জলি কাজ করে, সেখানে তার শিফটে কোনও অল্পবয়সি ছেলে থাকে না, জানার পরেই মেয়েকে তিনি কাজ করার অনুমতি দিয়েছিলেন। কারখানায় নিরাপত্তা ক্যামেরা লাগানো আছে জেনেও তিনি আশ্বস্ত হয়েছিলেন।

তিনি বললেন, “কোথাও গেলে ফোন করি, জানতে চাই কোথায় আছে ও।” অঞ্জলির অনুযোগ, “মা আমাকে কোথাও যেতে দেয় না।” মায়ের সাবধানী মন বলে, “ওকে বলি, চুপ করে বাড়িতে বসে থাক। মোবাইল দেখ। ভাল লাগলে টিক টক ভিডিও দেখ। যে ভুল তুই করেছিলি, সে পথে আর কোনও দিনও যাস না।”

জানতে চাই, ঠিক কী বলতে চাইছেন তিনি। অঞ্জলি কি দুর্ভাগ্যের শিকার ছিল না? ভালবাসা কি অন্যায়?

মায়ের জবাব, “হ্যাঁ, জানি ও প্রেমে পড়েছিল। কিন্তু যে ছেলেটার সঙ্গে প্রেম করেছে,তার মনে যে এই শয়তানি ছিল, কী করে বোঝা যাবে?” তাঁর ভয়, অঞ্জলির বয়স কম, সে অরক্ষিত। তাই যে কোনও ছেলে ওকে বিয়ের লোভ দেখাতে পারে।” মায়ের আশঙ্কা, “আমি তো কাজে চলে যাই … কেউ আবার ফুসলিয়ে নিয়ে হয়তো অন্য কোথাও বিক্রি করে দেবে।”

মায়ের কথার প্রতিবাদ করে অঞ্জলি বলে, “মানুষ একবার ধোঁকা খায়, বার বার নয়। আমার মাথায় এখন বুদ্ধিটা আছে।” এ বার মা বললেন,“ওকে আমি সব সময় বোঝাই, আর কোনও ছেলের সঙ্গে প্রেম করিস না, আর যদি করিস, আমায় বলবি। আমরা দেখেশুনে বিয়ে দেব। কিন্তু এ রকম করে আর পালিয়ে যাস না।…” মায়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই তাঁকে থামিয়ে দেয় অঞ্জলি। উদাসীন গলায় বলে, “কোনও ছেলেকে এখন আর আমি ভালবাসি না।” এই যেন তার শেষ কথা।

a woman silhouetted while holding her phone and an older woman stands in the background
a woman walking down the street waving back at a mother holding a baby
প্রথম গণিকালয় থেকে উদ্ধার হওয়ার পর অঞ্জলি শিলিগুড়িতে তার বাড়িতে মায়ের কাছে ফিরে যায়। তার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত মা সে কখন কোথায় থাকছে, খোঁজ নেন। এতে বিরক্ত হয় অঞ্জলি। সে আর একটু স্বাধীনতা চায়। বেশিরভাগ সময় একাই কাটায় সে। তার একাকীত্ব দূর করতে তার মোবাইল ফোনে প্রচুর ভিডিও দেখে সে।দ্বিতীয় শীতের এক ভোরে তার মা আর ভাইপোকে বিদায় জানিয়ে কারখানার কাজে বেরিয়ে যাচ্ছে অঞ্জলি। কারখানায় নিরাপত্তার জন্য ক্যামেরা লাগানো আছে এবং মেয়ের শিফটে কোনও পুরুষ কাজ করে না জেনেই মা অঞ্জলিকে কাজে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছেন। বেতন তেমন কিছু না-হলেও এই কাজ করার ফলে সে ব্যস্ত থাকে এবং বেঁচে থাকে তার অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার স্বপ্ন।

সত্যিই সে কী চায়, অঞ্জলি আমাকে বলেছিল। সে চায় যেখানে খুশি, যখন খুশি যেতে। বাড়ি ফিরে আসার কয়েক মাস বাদে কাজ থেকে ফিরে অঞ্জলি কাছেই এক বন্ধুর বাড়ি যেতে চেয়েছিল। তার যাওয়া নিরাপদ হবেনা বলে বাধা দিয়েছিলেন মা।অঞ্জলি এত রেগে গিয়েছিল যে, একটা কিছু ছুঁড়ে মেরেছিল টেলিভিশনের গায়ে, চুরমার হয়ে গিয়েছিল পর্দা।

কারখানায় সহজে যাওয়া আসা করার জন্য অঞ্জলি একটা স্কুটার কিনতে চেয়েছিল। মা যে তার বড় ভাইয়ের মোটরসাইকেল কেনার জন্য টাকা জমাচ্ছেন, সেটা তার পছন্দ ছিলনা।“মেয়ে চাইছে, মেয়েকে দেবেনা,” বলে অঞ্জলি।

“তোকেও দেব, যখন বিয়ে করবি, তখন দেব,” ধীর গলায় মা বলেছিলেন।

অঞ্জলি তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বিরক্তির হাসি হাসল। সে অবশ্য জানত, তার মতো পাচার হওয়া অনেক মেয়ের তুলনায় সে অনেক ভাগ্যবতী। আত্মীয়-পড়শিদের কাছে লজ্জার ভয়ে এইসব মেয়েদের পরিবার আর তাদের ফিরিয়ে নিতে চায় না। জীবনটাকে আর একবার গড়ে তোলার যে লড়াই অঞ্জলি শুরু করেছে, তা সফল হতে অনেক বাকি। তবু তার সংকল্প এবং তার পরিবারের পাশে থাকা দেখে সেদিন আমি আশা নিয়ে ফিরে এসেছিলাম।যে স্বাধীনতা অঞ্জলি চাইছে, তা একদিন সে খুঁজে পাবে।

যুধিজিৎ ভট্টাচার্য আমাদের একজন নিয়মিত লেখক। অপরাধ-বিষয়ক লেখা দিয়ে তিনি কলকাতায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। স্মিতা শর্মা, যিনি দিল্লিতে কাজ করেন, অনেক বছর ধরে ভারতে যৌন হিংসার উপর তথ্য সংগ্রহের কাজ করেছেন। এই পত্রিকার জন্য এটাই তাঁর প্রথম কাজ।
ইংরেজি থেকে অনুবাদঃ কুশল দাশগুপ্ত